শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০২৩

আড়াইহাজারে মানবপাচার চক্রের হোতা ইসমাইল ২ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার

প্রথম পাতা » আড়াইহাজার » আড়াইহাজারে মানবপাচার চক্রের হোতা ইসমাইল ২ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার
শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০২৩



আড়াইহাজারে মানবপাচার চক্রের হোতা ইসমাইল ২ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার

মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ১৯ যুবককে মায়ানমারে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি ও সেখানে বন্দিদশায় নির্যাতনের ফলে একজনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের মূলহোতা ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র‌্যাব।
নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে শনিবার (১৯ আগস্ট) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় র‌্যাব।

গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন-মানব পাচার চক্রের মূলহোতা মো. ইসমাইল (৪৫) ও তার সহযোগী মো. জসিম (৩৫) এবং মো. এলাহী (৫০)।

বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, গত ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানব পাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মায়ানমারের কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়। ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্ত (ইউএনও) এর কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান।

একই ঘটনায় ১৫ এপ্রিল আবুল কামলাম আজাদ বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় একটি মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করেন। এই চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার হওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে এবং গত ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে নিয়ে আসা হয়। এই ঘটনা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রচার হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। র‌্যাব মানব পাচারকারী এই চক্রটিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গোয়েন্দা নজদারী বৃদ্ধি করে।

গত শুক্রবার রাতে র‌্যাব-১১ এর একটি আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মূলহোতা ইসমাইলসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
র‌্যাব জানায়, ইসমাইল গত ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থানকালীন মায়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সাথে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে উঠে। পরে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে মায়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল এবং জামালের সাথে যোগসাজশে ১০-১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলে ও স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানবাপাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদেরকে কোন প্রকার অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌছানো হবে এবং মালয়েশিয়া পৌছানোর পরে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে প্রলোভন দেখাতো। ওই টাকা থেকে ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০ হাজার করে এবং চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার করে পেতেন। এবং বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো।

প্রাথমিক তদন্ত ও গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্যের বরাতে র‌্যাব জানায়, ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন যাপনের আশায় যে সকল তরুণ ও যুবকরা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করত তাদেরকে জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা উক্ত চক্রের মূলহোতা ইসমাইলের নিকট নিয়ে আসতো। তারপর তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসযোগে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মানব পাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের নিকট হস্তান্তর করতো। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদেরকে কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে তাদেরকে ট্রলার যোগে মায়ানমারে জামালের নিকট পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মায়ানমারের জামাল তার ক্যাম্পে ভোক্তভুগীদের রেখে নির্যাতন করে এবং তা ভিডিও করে গ্রেফতারকৃত ইসমাইলের মাধ্যমে ভোক্তভূগীদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ দেওয়া না হলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে পুনরায় নির্যাতন করা হত এবং যে সকল ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপনের টাকা প্রদান করে তাদেরকে মায়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের নিকট পাঠিয়ে দেয়। ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মায়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপনের টাকা তারা সমন্বয় করে ভাগ করে নিতো বলে জানা যায়। উল্লেখ্য রশিদুল প্রায় ২৫ বছর যাবৎ মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে এবং প্রায় ২০ বছর যাবৎ মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়।

র‌্যাব আরও জানায়, এই চক্রটি গত ১৯ মার্চ মোট ২২ জনকে ট্রলার যোগে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করার সময় মায়ানমার উপকূলে পৌছালে মায়ানমার কোস্টাগার্ড ১৯ জনকে গ্রেফতার হয় এবং অবশিষ্ট ৩ জনকে এই চক্রের সদস্য মায়ানমারের জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপনের জন্য নির্যাতন করে। তন্মধ্যে জহিরুলের পরিবারের নিকট ৬ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করে। পরবর্তীতে জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপন প্রদান করে এবং অবশিষ্ট ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌছানোর পর প্রদান করবে বলে জানায়।

পরবর্তীতে ভিকটিম জহিরুলকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মায়ানমার হতে থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া (জোহার বারুত) পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয় এবং মৃত্যু সনদপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। পরবর্তীতে ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়া সরকারের তত্ত্বাবধানে জহিরুলের মৃতদেহ বাংলাদেশে এনে তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এছাড়াও মায়ানমার কোস্টগার্ড কর্তৃক আটককৃত ১৯ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এর সাথে যোগাযোগ এর কার্যক্রম নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসন এর মাধ্যমে চলমান রয়েছে।

র‌্যাব জানায়, ইসমাইল নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে এই চক্রের দেশে এবং বিদেশে অবস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে অবৈধভাবে মানব পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে এবং ইতিপূর্বে সে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। জসিম ও এলাহী চক্রটির অন্যতম সহযোগী। তারা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশ গমনে প্রত্যাশীদের সংগ্রহ করে গ্রেফতারকৃত ইসমাইলের নিকট নিয়ে আসতো। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ২২:৪৯:১২   ৬০ বার পঠিত