দুপুর দেড়টা। সূর্যের প্রখরতায় নারায়ণগঞ্জ শহরে তখন তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র তাপদাহে যখন নাকাল নগরবাসী, শহরের নবাব সলিমউল্লাহ সড়কে তখন তুলনামূলক ঠান্ডা পরিবেশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল কিছুক্ষণ আগে এই সড়কে এক মেশিনের মাধ্যমে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। কিছুদূর এগিয়ে চাষাঢ়া গোলচত্ত্বরে দেখা মেলে ‘ওয়াটার মিস্ট ক্যানন’ নামে বিশেষ সেই মেশিনের।
এই মেশিন তৈরির নেপথ্যের কারিগর নাসিকের উপসহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) উৎপল বড়ুয়া জানালেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশেনর মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর উদ্যোগে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘ওয়াটার মিস্ট ক্যানন’ তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাপদাহ কমাতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে দৈনিক ৬ হাজার লিটার পানি ‘কুয়াশার মতো করে’ ছেটানো হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ যাবৎ এই মেশিনের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পানি ছেটানো হচ্ছে। এটি পরীক্ষামূলকভাবে চললেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেলে গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান এই প্রকৌশলী।
নগর কর্তৃপক্ষের এ উদ্যোগে গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহ থেকে কিছুটা স্বস্তি মিলছে বলেও জানান নগরবাসী।
চাষাঢ়ায় ‘ওয়াটার মিস্ট ক্যাননের’ সামনে রিকশা থামিয়ে চালকদের শীতল বাতাস উপভোগ করতে দেখা গেছে। তীব্র গরম থেকে একটু স্বস্তি পেতে ভিড় করছিলেন পথচারীরাও।
কথা হয় মোহাম্মদ নাহিদ নামে এক রিকশাচালকের সাথে। তিনি বলেন, ‘এই গরমে আমরা অসহ্য হইয়া গেছি। রাস্তা থেইকা মনে হয় আগুন উইঠা আসে। পেটে খাওন নাই দেইখা ঘরে থাকতে পারি না, রিকশা লইয়া বের হইতে হয়। গাড়ি দিয়া পানি ছিটাইতেছে, ঠান্ডা বাতাস আইতেছে। এইটা আমাগো শান্তি দিতেছে। পুরা শহর ঘুইরা ঘুইরা এমনে পানি দিলে মানুষের আরাম হইতো।’
অসুস্থ এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে সিলেট থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে এসেছেন ফারুক আহমেদ নামে এক বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাপদাহ কমাতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগে সাধুবাদ জানিয়ে ফারুক বলেন, ‘এইরকম গাড়ি ঢাকা ও চট্টগ্রামেও দেখেছি। তীব্র গরমে মানুষকে স্বস্তি দিতে এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এই ধরনের উদ্যোগ যেন সারাদেশেই নেওয়া হয় সেই দাবি জানাই।’
শহরের খাঁজা সুপার মার্কেটের একটি দোকানে বসেছিলেন হুমায়ূন কবির বাবুল। হঠাৎ মার্কেটের গলিতে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাওয়াতে বৃষ্টি নামলো কিনা ভেবেছিলেন তিনি। মার্কেট থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে দেখেন ‘ওয়াটার মিস্ট ক্যানন’ নামে বিশেষ এক পানি ছেটানোর যন্ত্র-সংযুক্ত গাড়ি দিয়ে পানি ছেটানোর কারণে এমন ঠান্ডা বাতাস।
‘নারায়ণগঞ্জে প্রচুর গরম। কিন্তু এই জায়গায় পানি ছেটানোয় শহরের অন্য জায়াগার তুলনায় তাপমাত্রা কমে গেছে। কিন্তু এইটা এক জায়গায় দিলে হবে না। গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে পুরো শহরজুড়ে এইটা করতে হবে। এমনটা করতে পারলে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ সফল হবে বলে মনে করি’, বলেন এই ব্যবসায়ী।
কথায় কথায় ‘ওয়াটার মিস্ট ক্যানন’ তৈরির অদ্যোপান্ত জানালেন নাসিকের প্রকৌশলী উৎপল বড়ুয়া। তিনি জানান, করোনা মহামারী চলাকালীন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এই ধরনের একটি মেশিন নেদারল্যান্ড থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কিনে আনেন। কম খরচে দেশীয়ভাবে এমন মেশিন তৈরি করা যায় কিনা, এমন একটি প্রস্তাব নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী তার প্রকৌশল বিভাগের সামনে তুলে ধরেন। পরে উৎপল বড়ুয়া এ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাকে বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করেন অটোমোবাইল প্রযুক্তিতে ডিপ্লোমা করা ইমরুল কায়েস নামে এক ব্যক্তি। গাড়ির সাথে সংযুক্ত করে এই মেশিন তৈরি করতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলেও জানান উৎপল। যা ঢাকা উত্তরের কেনা মেশিনের তুলনায় অনেক কম।
‘এর মাধ্যমে তাপমাত্রা তো খুব বেশি একটা কমাতে পারবো না কিন্তু আর্দ্রতা কন্ট্রোল করতে পারবো। মানুষ তীব্র গরম থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। নগরীর সড়কে ধুলোবালিও কমানো যাবে। যেখানে পানি ছেটানো হচ্ছে সেখানকার মানুষ এর ফিডব্যাকও ভালো দিচ্ছেন।’
এই মেশিনের বিশেষত্ব জানাতে গিয়ে উৎপল বলেন, ‘নরমাল কোন গাড়ি দিয়ে পানি ছেটাতে গেলে প্রায় ২৫ হাজার লিটার পানি দৈনিক ছেটানোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু ব্যতিক্রমী এই মেশিনের মাধ্যমে পানিকে কুয়াশার মতো তৈরি ছেটানোর কারণে অল্প পরিমাণ পানি লাগে। তাছাড়া এর সাথে ফ্যান সংযুক্ত থাকায় ছেটানো পানিও থাকে ঠান্ডা।’
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৮:৫৭ ২৮ বার পঠিত