২০৪০ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে নিকোটিন-নির্ভর বিকল্প পণ্যসমূহ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাজারজাতকরণের সুপারিশ করেছেন দেশি ও আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নীতিপ্রণেতারা। পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও ধূমপানের ক্ষতি হ্রাসের জন্য প্রচলিত সিগারেটের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পরামর্শ দেন গবেষকরা।
রাজধানীতে তামাকের ক্ষতি হ্রাসকরণ বিষয়ে আয়োজিত এক সম্মেলনে তারা বলেন তামাকের ক্ষতি হ্রাস ধারণাটি প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়াতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল উপায়। এর মাধ্যমে যারা ধূমপান ছাড়তে আগ্রহী, তারা প্রচলিত সিগারেটের বিকল্প হিসেবে তুলনামূলক কম ক্ষতিকর পণ্য (রিডিউসড রিস্ক প্রোডাক্ট) ব্যবহার করে। এই সকল পণ্য থেকে প্রচলিত সিগারেটের মতো টার তৈরী হয় না। যার ফলে এই পণ্যগুলো প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতিকর। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা।
বর্তমানে যুক্তরাজ্য, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে ধূমপানের হার কমিয়ে আনতে দেশগুলো সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় কম ক্ষতিকর পণ্যসমূহ যেমন ভেপ, ই-সিগারেট, স্নুস ইত্যাদি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) প্রণয়নের অন্যতম পথিকৃৎ ডা. ডেরেক ইয়াক বাংলাদেশের এফসিটিসি তৈরীর পেছনে অবদানের প্রশংসা করে বলেন, ‘ক্ষতিহ্রাস কৌশল আগে থেকেই এফসিটিসির অংশ ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য ক্ষতিহ্রাস কৌশলকে প্রাধান্য দেওয়ার। এতে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।’
অনুষ্ঠানে ধূমপানের ক্ষতি হ্রাস বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশেনের সাবেক মহাসচিব ডা. ডিলন হিউম্যান বলেন, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রধান লক্ষ্য হলো রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং রোগের কারণে অকাল মৃত্যু ঠেকানো। তিনি বলেন, ‘এতোদিনের প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করা সম্ভব হবে না।’
ডা. হিউম্যান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক তিনজন মহাপরিচালকের একজন এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর মতে, বর্তমানে বিশ্বে ১৪০ কোটি ধূমপায়ী আছে, যার দুই কোটি বাংলাদেশে। প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রণ কৌশল এদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানার শামিল। এমন পরিস্থিতি উত্তোরণে তামাকের ক্ষতি হ্রাসে সমন্বিত কৌশল, বিজ্ঞান এবং কম ক্ষতিকর বিকল্পের নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ডিলন।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও তামাকের ক্ষতি হ্রাস নিয়ে ৭০টির বেশি গবেষণায় কাজ করা ডা. কনসটেন্টিনোস ফার্সিলিনোস বলেন, “ইউকে হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সির গবেষণায় ধূমপানের ক্ষতিহ্রাস কৌশলের বিকল্প ভেপিং সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভেপিং এবং নিকোটিন চুইংগাম ধূমপানের আসক্তি কাটানোর জন্য অন্যতম সহায়ক হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত। ধূমপানের এসব বিকল্প পণ্য বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য এবং একটি ঝুঁকি অনুপাতিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করা গেলে প্রচুর মানুষকে ধূমপানের মতো ক্ষতিকর নেশা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ডা. হোসির মতে, ধূমপায়ীদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছাড়তে বিকল্পে আগ্রহী করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের করণীয় অনেক। তিনি বলেন, “ভোক্তা এবং রোগীদের সঠিক তথ্য এবং পণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানাতে হবে। যদি তারা ধূমপান একেবারে ছাড়তে না পারে তবে তাদের তুলনামূলক কম ক্ষতিকর পণ্য বেছে নিতে সহায়তা করতে হবে।“
আলোচকেরা বলেন, বাংলাদেশ সকল বাধা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সুপরিচিত এবং বিশ্বের অন্যতম দ্রুত ক্রমবর্ধন অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের প্রয়োজন উন্নত বিশ্বে সাফল্য লাভ করেছে এমন নির্ভরযোগ্য ও পরীক্ষিত ক্ষতি হ্রাস কৌশল অনুসরণ করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তামাকমুক্ত হওয়ার পাশাপাশি এশিয়া এবং সারা বিশ্বের কাছে একটি রোল মডেল হয়ে উঠবে।
সম্মেলনে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেন ভয়েস অব ভেপার্স বাংলাদেশের মুখপাত্র মাসুদ উজ জামান, ওয়ার্ল্ড ভেপার্স আলিয়ান্স এর পরিচালক মাইকেল ল্যান্ডাল ও গবেষণা সংগঠন উই আর ইনোভেশন এর প্রধান ফ্রেডরিকো ফার্নান্ডেজ।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:১২:২৮ ১৭৮ বার পঠিত