বিশ্বের শীর্ষ সাত অর্থনীতির দেশের জোট জি-সেভেন। সম্প্রতি জাপানের হিরোশিমায় হয়ে গেল এর শীর্ষ সম্মেলন, যার বড় অংশই দখল করে রেখেছিল চীন ও রাশিয়া। আবার এ দেশ দুটিই পৃথকভাবে চীন-মধ্য এশিয়া সম্মেলন এবং রাশিয়া-ইসলামি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। এসব আয়োজন যে স্পষ্টতই প্রভাব বিস্তারের খেলা, তা না বললেও চলে। তবে এসব খেলায় কে এগিয়ে?
জাপানের হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনকে সরাসরি যুদ্ধবিমান এবং আরও সামরিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এটা স্পষ্টতই রাশিয়ার বিপক্ষে গেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, জোটটি চীনের ব্যাপারে একটি দ্বিমুখী অবস্থান নিয়েছে।
জি-৭ চীনকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সামরিকায়নের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তবে আবার বেইজিংয়ের সঙ্গে ‘গঠনমূলক এবং স্থিতিশীল’ সম্পর্কও স্থাপন করার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। সোজা কথায় সম্মেলনে চীনের বিষয়ে দুই ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমত, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং সামরিক কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া নজর রাখা এবং দ্বিতীয়ত দেশটির সঙ্গে কোনো ধরনের উত্তেজনা পরিহার করা।
চীনের বিষয়ে এক বিবৃতিতে জি-৭ বলেছে, ‘চীনের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযুক্ত থাকার গুরুত্ব স্বীকার করে আমরা দেশটির সঙ্গে একটি গঠনমূলক এবং স্থিতিশীল সম্পর্ক স্থাপনে প্রস্তুত। তবে আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়ও সরাসরি চীনকে জানাতে চাই।’
তবে জোটটি চীনকে দক্ষিণ চীন সাগরে তার ক্রমবর্ধমান সামরিকায়নের বিষয়েও সতর্ক করেছে। পাশাপাশি চীনকে উদ্দেশ করে বলেছে, বিশ্বের নিরাপত্তার জন্যই তাইওয়ান প্রণালিতে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা জরুরি।
জি-৭ বিবৃতিতে আরও বলেছে, ‘আমাদের নীতি চীনের ক্ষতি করার জন্য করা হয়নি এবং আমরা চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টাও করি না।’
এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জি-৭ চীনকে আস্থায় নিতে পারেনি; আবার তাকে সরাসরি প্রতিপক্ষ বলেও আখ্যা দিতে পারছে না।
এদিকে, হিরোশিমায় যখন জি-৭ সম্মেলন হচ্ছে প্রায় একই সময়ে চীনের জিয়ান শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে চীন-মধ্য এশিয়া সম্মেলন। সেখানে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা যোগ দিয়েছিলেন। প্রাচীন সিল্ক রুটের ওপর অবস্থিত জিয়ান শহরটিকেই চীন-মধ্য এশিয়া সম্মেলনের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ হলো, এ রুটের অন্যতম অংশীদার মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে চীনের নতুন সিল্ক রুট তথা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি করানো।
এরই মধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে চীন কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা থেকে দেশটি মুনাফাসহ তুলে আনতে সচেষ্ট হবে।
এরই ধারাবাহিকতায়, চীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। আর এক্ষেত্রে দেশটি অনেকটাই সফলও বলা চলে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরোপীয়-মধ্য এশিয়া বিষয়ক বিভাগের উপ-মহাপরিচালক ইউ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নেতারা একটি পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়ে মত বিনিময় করবেন। তিনি আরও বলেন, এতে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ সম্মেলনকে মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে চীন এসব দেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমারত তোকায়েভের মন্তব্যের মধ্যদিয়ে। তিনি জানান, চীনের সঙ্গে ‘স্থায়ী বন্ধুত্ব’ তৈরি এবং সুখ-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়েই চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠক শেষ হয়েছে।
চীন যে তার মধ্য এশিয়া সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে, তা কাসিম জোমারত তোকায়েভের কথা থেকে স্পষ্ট। এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক রাশিয়ার দিকে। দেশটির কাজানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, শিয়া-ইসলামিক ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক ফোরামের সম্মেলন। সেখানে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধি, মালয়েশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নেতারা অংশ নেন।
সম্মেলনের বিষয়টি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী মারাত খুশনুলিন বলেন, ‘ইসলামি বিশ্ব রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করে না। চলতি সপ্তাহে কাজানে অনুষ্ঠিত রাশিয়া-ইসলামিক ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক ফোরামে স্বাক্ষরিত চুক্তি এটাই প্রমাণ করে।’
রাশিয়ার এ উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই ফোরামটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আলোচনা উপযুক্ত স্থান হয়ে উঠেছিল। কারণ, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো আমাদের সমর্থন করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুসলিম বিশ্বের একটা দেশও আমাদের ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে না।’
এছাড়া মারাত খুশনুলিন ভবিষ্যতে ইসলামি বিশ্বের সঙ্গে সড়ক, বিমান এবং জলপথে একটি বাণিজ্যিক করিডোর স্থাপনের বিষয়েও কথা বলেন। যা রাশিয়া থেকে সরাসরি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইসলামি বিশ্বে পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, তিনটি সম্মেলনই যার যার জায়গা থেকে সফল হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, রাশিয়া এবং চীনকে জি-৭ তাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষ বলেই ধরে নিচ্ছে। যদিও চীনের বেলায় জি-৭ এর অবস্থান দ্ব্যর্থক তবে রাশিয়ার বেলায় এর অবস্থান স্পষ্ট। তবে পরস্পরবিরোধী এই তিন সম্মেলন থেকে এটি স্পষ্ট যে, বিশ্ব রাজনীতিতে মেরুকরণের বিভেদ রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। যেখানে চীন তার প্রভাব বাড়ানোর দৌড়ে স্পষ্ট এগিয়ে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, ডয়েচে ভেলে এবং আরটি
বাংলাদেশ সময়: ১০:১০:০৯ ৭৬ বার পঠিত