নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবাসহ ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব।
র্যাব বলছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার ইসহাক গত বছর ঢাকার আদালত চত্বর থেকে দুই দুর্ধর্ষ জঙ্গি সদস্য পালানোর বিষয়টি জানতেন। তবে পলাতক জঙ্গিদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি ইসহাক।
তবে কাশেমপুর কারাগারে গ্রেপ্তার আনসার আল ইসলামের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ ও স্বজনদের দেখা করিয়ে দেওয়ার কাজ করতেন ইসহাক। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত পান তিনি। ইসহাকের নির্দেশে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে যায় চার জঙ্গি সদস্য। যাদের প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তবে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে গ্রেপ্তার হন তারা।
ডিজিএফআইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতায় রোববার (১০ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব-১ এর একটি দল।
গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন– মো. শরিফুল ইসলাম ওরফে মুরাদ (৩১), আশিকুর রহমান ওরফে উসাইমান (২৭), মুহাম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবরার (২৪), মো. আল আমিন ওরফে রবিন ওরফে সামুরা (২৪) ও মো. আবু জর ওরফে মারুফ (১৮)। এসময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ উগ্রবাদী বই এবং অন্যান্য সরঞ্জাম।
সোমবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’-এর সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমির ও শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ শতাধিক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এছাড়াও নিষিদ্ধ ঘোষিত অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে র্যাবের নিয়মিত নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার এবং হলি আর্টিজান হামলার পরবর্তী সময়ে প্রায় ২ হাজার জঙ্গিকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে র্যাব। যখনই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়েছে তখনই র্যাব ফোর্সেস সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-১ এর একটি দল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তাররা বিভিন্ন উগ্রবাদী বই, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতেন। এছাড়াও তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদ্রাসা ও সদস্যদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন সময়ে তারা মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতেন এবং তারা সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠাতেন।
বর্তমান আমির আবু ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ইসহাকের, দিতেন প্রশিক্ষণ
দাখিল পর্যন্ত পড়াশোনা করা গ্রেপ্তার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা ২০১৫ সালে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। বিভিন্ন পেশার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
তিনি সংগঠনের রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রশিক্ষণ শাখার প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। আনসার আল ইসলামের বর্তমান আমির আবু ইমরানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল ইসহাকের। আমিরের নির্দেশেই তিনি রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।
অনলাইনে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন ইসহাক
অনলাইন মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন। তার নির্দেশে সংগঠনের নতুন সদস্যদের গাজীপুর, টঙ্গী ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন আনসার হাউজে তাত্ত্বিক ও শারীরিক কসরতসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় অ্যাপস ব্যবহার করে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিতেন এবং সংগঠনে তার অনুসারীদের দিকনির্দেশনা দিতেন।
কাটআউট সিস্টেম বিষয়ে প্রশিক্ষণ
সংগঠনে নতুন রিক্রুট করা সদস্যদের কাটআউট সিস্টেম সম্পর্কিত বিষয়ে মৌখিক এবং লিখিত প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। কাটআউট সিস্টেমের নীতিমালা মেনে চলার নির্দেশনা দিতেন।
পার্শ্ববর্তী দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ, পাঠাতেন প্রশিক্ষণের জন্যও
পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতেন। তার নির্দেশনায় গ্রেপ্তার শরিফুল সংগঠনের বেশকিছু সদস্যকে তথাকথিত হিজরত ও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়েছিলেন। ইসহাকের নির্দেশে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানো চারজন সদস্য এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়।
কারাগারে বন্দি জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ইসহাকের
কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আনসার আল ইসলামের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতেন। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেখা করিয়ে দিতেন। তিনি আনসার আল ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় করায় সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক সাইবা হিসেবে পরিচিত পান।
নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন হাফেজ আশিক
কুরআনের হাফেজ গ্রেপ্তার আশিকুর রহমান ময়মনসিংহ এলাকায় হিজামার ব্যবসা করতেন। ২০১৮ সালে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকেন।
পর তিনি সংগঠনের ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম প্রধান সেকশন চিফ হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তিনি সংগঠনের জিহাদি প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। নতুন সদস্যদের সংগঠন ও তথাকথিত জিহাদ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য উগ্রবাদী বই সরবরাহ করতেন। গ্রেপ্তার ইসহাকের নির্দেশনায় আশিক সংগঠনের মাসুলদের অধীন হিসেবে নতুন সদস্যদের বণ্টন করার দায়িত্ব পালন করতেন।
রকমারি ব্যবসার আড়ালে দাওয়াতি কাজ করেন জাকারিয়া
গ্রেপ্তার জাকারিয়া ওরফে আবরার স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পড়া সম্পন্ন করেন। তিনি ২০২০ সালে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। তিনি ভ্রাম্যমাণ রকমারি ব্যবসার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম ও নতুন সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তিনি রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার এবং মানিকগঞ্জ জেলার সংগঠনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
তিনি গ্রেপ্তার আশিকের নির্দেশে কারাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ব্লাকবেল্ট অর্জন করেন। পরে তিনি গ্রেপ্তার ইসহাকের নির্দেশে সংগঠনের সদস্যদের সাভার ও গাজীপুর, টঙ্গীর বিভিন্ন আনসার হাউজে শারীরিক (কারাতে) প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। এছাড়াও তিনি নতুন সদস্য সংগ্রহসহ সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন।
গ্রেপ্তার শরিফুল স্থানীয় একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা থেকে হেফজ সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৮ সালে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। ইসহাকের নির্দেশে সংগঠনের চারজন সদস্যসহ ২০১৯ সালের শুরুর দিকে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও তথাকথিত জিহাদের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে যান। ২০১৯ সালের শেষের দিকে অন্য সদস্যদের রেখে কৌশলে তিনি ফিরে আসেন। পুনরায় তিনি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতেন বলে জানান।
তিনি পার্শ্ববর্তী দেশের সমমনা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তথাকথিত হিজরত ও প্রশিক্ষণের উদ্দেশে অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে নতুন রিক্রুট জঙ্গিদের প্রেরণ করেন। এছাড়াও তিনি ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে সভার আয়োজন করতেন।
গ্রেপ্তার আল আমিন ওরফে রবিন স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৯ সালে রাকিবের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন। তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
পরে তিনি ২০২১ সালে আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জন্য পার্বত্য এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের কাজ করতেন।
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অর্থ শাখার প্রধান গ্রেপ্তার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। তিনি মোশারফ হোসেনের নির্দেশে কেএনএফ’র প্রশাসন ও অর্থ শাখার পাসেন মিরাম নামক ব্যক্তির কাছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ পাঠাতেন বলে জানা যায়। এছাড়াও তার সঙ্গে কুকি চিন-এর নেতৃস্থানীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেপ্তার আবু জর ওরফে মারুফ স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় জালালাইনে অধ্যয়নরত। তিনি ২০২২ সালে গ্রেপ্তার জাকারিয়ার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন। তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং ভ্রাম্যমাণ রকমারি ব্যবসার আড়ালে তার নিজ এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৪৩:০৪ ৬৫ বার পঠিত