বঙ্গবন্ধু কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ১৯৭৯ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা খুনিদের বিচারের দাবি উত্থাপন করেন, এটি ছিল বিশ্বদরবারে এ নৃশংস হত্যাকা-ের বিচারের প্রথম আহ্বান।
তিনি স্টকহোমে ১৯৭৯ সালের ১০ মে ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে সর্ব-ইউরোপীয় বাকশালের এক সম্মেলনে বক্তৃতার মাধ্যমে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সেই আবেগঘন পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের ওপর বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টির সেই অনন্য নজির ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে আছে।
শেখ রেহানার জন্মদিনে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে মুজিব হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে লন্ডনে বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করেন।
আমু স্মরণ করেন, তারা সন ম্যাকব্রাইডের অধীনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং দেশে এসে ঘটনা তদন্তে তাদের তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেন। তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকার তাদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।
তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা যদি সে সময় বিদেশে না থাকতেন, তাহলে আরও কতদিন যে আমরা নিপীড়নের শিকার হতাম, আরও কতদিন যে আমরা ঘাতকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হতাম, কে জানে?’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেন পল্টু বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর দুই কন্যা খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী ও দেশি-বিদেশি শক্তি বিচারের পথ রুদ্ধ করে এবং তৎকালীন সেনা সমর্থিত শাসকরা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা-শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে স্বদেশে ফিরতে অনুমতি দেয়নি।
তিনি যোগ করেন, শেখ রেহানা নির্বাসনে থাকাকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ও মানবাধিকার সংস্থার কাছে তাঁর বাবার হত্যার বিচারের দাবি উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণের মিশনে রেহানা তাঁর বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে একজন আদর্শ বোন এবং নিঃস্বার্থ সমর্থনের উৎস।
তিনি বলেন, দুই বোন জন্মসূত্রে বন্ধনে আবদ্ধ এবং তারা অত্যন্ত যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সময়েও শেখ রেহানা শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য দেশে ও বিদেশে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শেখ রেহানা দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সংগ্রামে সব সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের তদন্ত করতে লন্ডনে কমিশন গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিধ্বনি করে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ১৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা-শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জীবন কখনোই সহজ ছিল না।
তিনি বলেন, আগের রাতে তারা বেলজিয়ামে একজন কূটনীতিকের বাসায় এক পার্টিতে আনন্দ করছিলেন। অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর একই ব্যক্তি তাদের বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য গাড়িতে লিফট দিতে অস্বীকার করে।
নাছিম বলেন, একদিনে সবকিছু হারানোর পর, তারা হৃদয়ে গভীর শোক চেপে রেখে খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে সম্ভাব্য সবার কাছে যান।
তিনি বলেন, সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তারা জাতির পিতার খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।
তিনি বলেন, অবশেষে খুনিদের বিচারের আওতায় এনে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হয়।
শেখ রেহানা প্রখ্যাত আইনবিদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষের আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস, কিউসি’র সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করেন।
ইতিহাস বলে শেখ রেহানা প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস, কিউসি’র সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করেন। স্যার টমাস ইউলিয়ামস আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ছিলেন। তিনি ড. শফিকের সাথে হাউস অফ কমন্সে স্যার টমাসের সাথে দেখা করেন, তাকে সর্ব-ইউরোপ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতির পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি এই অনুরোধ ফেলতে পারেননি।
১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পঞ্চম বছর স্মরণে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল-যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় সমাবেশ ছিল। সেখানে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস, কিউসি প্রধান বক্তা ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির ডক্টর কনরাড উড এবং ব্রিটিশ লেবার পার্টির দু’জন আইনপ্রণেতা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সেখানে স্যার টমাস উইলিয়ামস ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হাউস অফ কমন্সের কাছে একটি রেস্তোরাঁয় এই প্রবীণ আইনজ্ঞ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। এই কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি নিজে এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও আইরিশ আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড ছিলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য। জেফরি টমাস এমপি ও সলিসিটর অ্যাব্রে রোজ ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেন, তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং ভিসা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি ফেব্রুয়ারিতে হাউস অফ লর্ডস পর্যন্ত গড়ায়।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড ক্যারিংটনসহ অনেকে এ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন। আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৪৪:৩০ ৭২ বার পঠিত