নিজস্ব প্রতিবেদক : সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বিতর্কিত ৪২ধারা বাতিলের জোর দাবি জানান হলেও সেই বিতর্কিত ধারাটি বজায় রেখেই জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩’ বিল পাসের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে সংসদীয় কমিটি। তবে বিলের ৩২ ধারাটি (অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের বিধান) বাতিল ববেং ২১ ধারার সংশোধনসহ বেশ কয়েকটি ধারায় সংশোধন ও কিছু ক্ষেত্রে ভাষাগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিলটি চূড়ান্ত করে সংসদে প্রতিবেদন উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরআগে সংশোধিত খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে গত মঙ্গলবার বিলটি সংসদে তোলা হয়। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
সংসদীয় কমিটির সভাপতির অনুপস্থিতিতে কমিটির সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, আহমেদ ফিরোজ কবির, মো. নুরুল আমিন, মনিরা সুলতানা ও জাকিয়া পারভীন খানম অংশ নেন। বিশেষ আমন্ত্রণে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, বাংলাদেশ
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)’র সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজে একাংশের মহাসচিব দীপ আজাদ, বিএফইউজে আরেকাংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, প্রেস ক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ডিইউজে’র সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রমুখ।
বৈঠক শেষে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিক নেতাদের দাবি ও পরামর্শক্রমে আমরা বিলে অনেক পরিবর্তন করেছি। বিলের ২১ ধারার বিষয়ে বিএফইউজে থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, আমরা তা গ্রহণ করেছি। ৩২ ধারার অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিল করে দিয়েছি, এ আইনে সেটা থাকবে না। মিথ্যা মামলার বিষয়ে যে পরামর্শ এসেছে সেটা আমরা গ্রহণ করেছি। দ্রুত সংসদে বিলের প্রতিবেদন সংসদে জমা দেওয়া হবে।
এরআগে বিএফইউজে’র সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আগেই সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। প্রস্তাবগুলো থেকে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিল ৩২ ধারা বাতিল এবং ২১ ধারাসহ কয়েকটি ধারা সংশোধন করার বিষয়ে কমিটি সম্মত হয়েছে। বিলের ৪২ ধারায় সংজ্ঞাগত কিছু পরিবর্তন এনেছে। সাব-ইন্সপেক্টার পর্যায়ের কর্মকর্তার স্থলে ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকতার করা হয়েছে। তবে আমরা এক্ষেত্রে সন্তুষ্ট নই। আমরা প্রেস কাউন্সিলের কথাই বলেছি।
প্রস্তাবিত আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছিল। তবে তা পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়নি। এখানে পুলিশ পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, এমন সংশোধনী আনা হচ্ছে।
প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। যে সমস্ত বিষয়ে সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে সেটা আমরা কমিটিতে জানিয়েছি। তারা সেগুলো সংশোধন করবেন বলে জানিয়েছেন। কমিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাতিলসহ বেশ কয়েকটি ধারায় আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করে সংশোধনী এনেছে।
বিএফইউজে (একাংশ) সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, সংসদীয় দু-একটি জায়গায় ভাষাগত পরিবর্তনে এনেছে। তবে, আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। আলোচনাকালে আমরা ১৪ দফা দাবির বিষয়ে অনড় ছিলাম। বিশেষ করে ৪২ ধারায় বিনাপরোয়ানায় গ্রেফতার, তল্লাশির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছি। আমরা বলেছি স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধাগ্রস্ত হয়, এমন ধারাগুলো বাতিলে করে সংশোধনী আনলেই কেবল আমরা মেনে নেবো।
সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করেছেন ডিইউজে’র সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন। তিনি বলেন, আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক ৪২ধারা বাতিলের জন্য বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু তা কাজে আসেনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৪৩ ধারা এই বিলের ৪২ধারায় হুবহ রাখা হয়েছে। কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হলেও তা কতোটা হবে তা সংশোধিত বিলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলে জানা যাবে। সেটা দেখার পরই ডিইউজে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।
বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া বিলের ৩২ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। এই ধারায় কিছু শব্দগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই ধারায় বিএফইউজের প্রস্তাব ছিল ‘বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো হবে অপরাধ’ এটি প্রতিস্থাপন করা। তাদের এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে সংসদীয় কমিটি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৩:৩৬ ১৬০ বার পঠিত