দেশে ক্রমেই বাড়ছে নতুন ধরনের সাইবার অপরাধের মাত্রা। এর শিকার হচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ। মাধ্যমটি ব্যবহার করে বেড়েছে আর্থিক প্রতারণাও। একই সঙ্গে মানুষের অনলাইনে কেনাকাটার অভ্যাস বাড়ারও সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্র। অনলাইনে বিভিন্ন রকমের চটকদার বিজ্ঞাপন বা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে করা হচ্ছে প্রতারণা। অনলাইনে নানা রকম ফাঁদ পেতে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা।
মাঠপর্যায়ে অপরাধ কিছুটা কমলেও সাইবার অপরাধ আবির্ভূত হচ্ছে নতুন নতুন রূপে। এতে হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি মারুফ কামরুল (২৭) নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী এমনই এক প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন। অনলাইনে টু-লেট গ্রুপে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন তিনি। কম টাকায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ বাসা ভাড়া পাওয়ায় দুই পক্ষেই কথা আগায়। একপর্যায়ে পোস্টদাতা কয়েকজন আগ্রহীর কথা বলে কামরুলের কাছে বাসা ভাড়ার ব্যাপারে দুমাসের অ্যাডভান্স দাবি করে বলেন, ‘বাসা নিতে হলে আপনাকে এখনই অ্যাডভ্যান্স করতে হবে।’
সব শর্ত মিলে যাওয়ায় মারুফও সামনাসামনি বাসা না দেখে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাকে টাকা পাঠিয়ে দেন। দুদিন পর পোস্টদাতার দেয়া ঠিকানামতো বাসা দেখতে গিয়ে আসলে সেখানে কোনো বাসার খোঁজ পাননি মারুফ। পোস্টদাতার মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই অনলাইনে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে প্রতারণার স্বীকার হন তিনি।
শুধু মারুফই নন, রাজধানীতে অনলাইনে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে এমন অনেক ভুক্তভোগীর খোঁজ পাওয়া যায়। কেউ বাসা ভাড়া নিতে, কেউ বাসার সরঞ্জাম কিনতে প্রতিনিয়তই হয়রানিতে পড়েছেন; খুয়েছেন অর্থ।
প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, ততই হুমকিতে পড়ছে সাইবার নিরাপত্তা। সাইবার অপরাধের অভিনব ও বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন ই-ট্রানজেকশন, হ্যাকিং ও অনলাইনে প্রতারণা। এসব অপরাধের মূল লক্ষ্য কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করা। এ ধরনের অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোও আক্রান্ত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থিকভাবেও।
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও অপরাধ শনাক্তে বিলম্বের কারণে অর্থসংক্রান্ত অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও তদন্তে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে এসব অপরাধ মোকাবিলা করতে চায় পুলিশ।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। ফেসবুক, ইউটিউব, লাইকি, টিকটক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো ভিডিও চ্যাট, বিগো লাইভের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ বেড়েই চলেছে। এআই ব্যবহার করে যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) তৈরি করে হয়রানির সংখ্যা বেড়েছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই নয়, অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনাও বেড়েছে। নতুন যুক্ত হয়েছে এটিএম হ্যাকিং। এছাড়া ই-কমার্সে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনাও সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে।
এক গবেষণা প্রতিবেদনের সামগ্রিক ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে চার ধরনের অপরাধের মাত্রা কমেছে; অন্যদিকে, ছয় ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের হার হতাশাজনক। অপরাধ বিশ্লেষণে বলা হয়, দেশে সাইবার-সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সাইবার লিটারেসিও বাড়াতে হবে।
সাইবার অপরাধের প্রায় অর্ধেকই অর্থসংক্রান্ত
ঢাকার সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে চারটি ভিন্ন আইনের অধীনে প্রতি মাসে গড়ে ১৬৯টি সাইবার-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৪। আর গত বছর এটি আরো বেড়েছে। ২০২২ সালে সাইবার-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩১৩টি। এর মধ্যে ২৮০টি মামলা তদন্ত করে সিটিটিসি।
এসব মামলার মধ্যে ফেসবুক-সংক্রান্ত মানহানির ৯১টি ও পর্নোগ্রাফির মামলা ৫৮টি। এর বাইরে হ্যাকিং-সংক্রান্ত ৫১টি, ই-ট্রানজেকশনের ৪২, অনলাইন প্রতারণায় ২০ ও তথ্যপ্রযুক্তির মামলা ১৮টি। তথ্যপ্রযুক্তি, অনলাইন প্রতারণা, ই-ট্রানজেকশন ও হাকিংয়ের ঘটনায় দায়ের হওয়া ১৩১টি মামলার সবগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল অর্থ হাতিয়ে নেয়া, যা সাইবার-সংক্রান্ত মোট মামলার ৪৭ শতাংশ।
ডিএমপির পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে প্রতারণা, জালিয়াতি ও ডিজিটাল অপরাধের ঘটনা। জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ, আর্থিক জালিয়াতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে দেয়ার আশ্বাস এবং আবাসন ব্যবসা সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
সাইবার অপরাধের মধ্যে বিকাশ-নগদ-রকেটের মতো আর্থিক লেনদেনে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট এবং এটিএম বুথ হ্যাকিংয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। এছাড়া ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, বুমবুম, কিউকম, ধামাকাসহ এমন বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পণ্য প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও সাম্প্রতিক বছরে ঘটেছে।
সাইবার অপরাধের মধ্যে শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য জালিয়াতি করে জাল সনদ তৈরি, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ও প্রতারণা, অনলাইনে প্রশ্ন ফাঁস করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অপরাধও রয়েছে। এর বাইরে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমেও দেশে সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব অপরাধের উদ্দেশ্যও অর্থ হাতিয়ে নেয়া।
সাইবার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অপরাধ বেড়ে যাওয়া এবং এর কারণ বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বেশকিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। ঢাকার অপরাধ বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের যেসব বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, তার মধ্যে রয়েছে নগরবাসীর আর্থসামাজিক অবস্থা, অতিদ্রুত অবকাঠামোগত পরিবর্তন, প্রতিবেশী সংস্কৃতির বিলুপ্তি এবং বিপুলসংখ্যক ভাসমান ও ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর বিস্তার। রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি সেখানে অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটছে। এর বহুমুখী কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো দরিদ্রতা ও অপরাধপ্রবণতা। অঞ্চলভেদে মানুষের জীবনচিত্র ও তাদের কর্মসংস্থানের উৎস, পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংস্কৃতিও জড়িত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার সামাজিক বৈষম্য দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ধনীরা যেমন দিন দিন আরো বেশি সম্পদশালী হয়ে উঠছে, তেমনি এর বিপরীতে দরিদ্ররা আরো বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ছে। ফলে শ্রেণিবৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করছে, এতে সামাজিক চাপ বাড়ছে। এ কারণে অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
সাইবারকেন্দ্রিক আর্থিক অপরাধগুলোর পেছনে বেশ কয়েকটি পক্ষ কাজ করে। এ ধরনের চক্রগুলোকে দ্রুত শনাক্ত করতে না পারলে তারা একই ধরনের অপরাধ বারবার করতে থাকে। এক্ষেত্রে শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাওয়া অপরাধীদের দেখে অন্যরাও এসব অপরাধে উৎসাহিত হয়। অর্থসংক্রান্ত এসব অপরাধ মোকাবেলা করতে হলে উন্নত প্রযুক্তির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফরেনসিক তদন্তসংক্রান্ত দক্ষতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের বিশেষায়িত ইউনিটের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধী শনাক্ত এবং সঠিক তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে অর্থসংক্রান্ত সাইবারজগতের ক্রমবর্ধমান অপরাধ মোকাবিলায় বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ডিএমপি। সিডিএমএস, সিআইএমএস ও এসআইভিএস প্লাসের মতো আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে অপরাধ ও অপরাধীদের পর্যালোচনা করে এটি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন,
ঢাকা মহানগরীতে ম্যানুয়াল অপরাধ কমে গেছে। বেড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন অপরাধ। এসব অপরাধ ম্যানুয়াল সোর্স দিয়ে প্রতিরোধ বা অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা কঠিন। প্রায় সময়ই তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। বিশেষ করে এখন অপরাধীরা ম্যানুয়ালভাবে অপরাধ করতেও বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এসব অপরাধ মোকাবেলায় বিভিন্ন উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে।
উদাহরণ তুলে ধরে ডিএমপির এ উপ-পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, হত্যা বা ধর্ষণের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে অপরাধীদের খুব দ্রুত শনাক্ত করা যায়। কিন্তু অর্থসংক্রান্ত অপরাধগুলো শনাক্ত করা বেশ জটিল। এ ধরনের অপরাধ একটা সংঘটিত হয়েই যে থেমে যায়, তেমনটিও নয়। বরং অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করা না গেলে এ ধরনের অপরাধ বারবার ঘটতে থাকে। এটা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার জন্য হুমকি। আর্থিক এসব অপরাধের ঘটনা তদন্তে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে। অপরাধ ঘটিয়ে এখন আর পালিয়ে থাকার সুযোগ নেই।
প্রতিকার কোন পথে
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক গুণ বেড়েছে। এতে ভবিষ্যতে এই নিরাপত্তাঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। তার জন্য সাবধান হওয়ারও এখনই সময়। ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। অনলাইনে কেনাকাটা ও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বারবার যাচাই করা। নিয়মিত তথ্য বা ইনফরমেশন সিকিউরিটি রিভিউ করা, ইনফরমেশন সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা, ইনফরমেশন সিকিউরিটি নিশ্চিন্তে ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট ও পেনিট্রেশন টেস্ট বা এথিক্যাল হ্যাকিং করে দেখা, ব্যক্তিগত ই-মেইলের সঙ্গে অফিসের ই-মেইল মিলিয়ে না ফেলা, অফিসের তথ্য আদান-প্রদানে ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার না করা, নিয়মিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর প্রযুক্তি নিরাপত্তা নজরদারি এবং প্রযুক্তি নিরীক্ষা আমাদের এ ক্ষেত্রে অনেক রক্ষাকবচ দিতে পারে।
গত সোমবার (২৮ আগস্ট) সাইবার নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। যেখানে সাইবার অপরাধের অনেকগুলো বিষয় উঠে আসে। এতে নতুন করে সাজা নির্ধারণ করা হয়। যদি আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা যায় তাহলে এসব সাইবার অপরাধ কমে আসতে পারে বলে মত অনেকের।
দেশে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীজনসহ সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো অধ্যায় পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা যায় কি না, সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। তৃণমূল পর্যায় থেকে অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:১৪:৪৫ ৫০ বার পঠিত