অবশেষে দীর্ঘ এক যুগের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের কাজ এখন অনেকটাই শেষের পথে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসেই এটি চালুর সম্ভাবনা। আর একে ঘিরে মোংলা বন্দরের গতিশীলতাও বাড়বে। এতে নতুন মোড় ঘুরবে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, রেলপথের শেষ প্রান্ত মোংলা স্টেশনে শেষ সময়ে ডাম্পিং মেশিনের সাহায্যে রেললাইন সমান করা, পাথর বসানোসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারত সরকারের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। ২০১০ সালে খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর এর সম্ভ্যাবতা যাচাই, ডিজাইন চূড়ান্ত, দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার নিয়োগসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে।
এরপর ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায়ও কাজ বাধাগ্রস্ত হয় বেশ কয়েকবার। পাঁচ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে সবশেষ আগামী সেপ্টেম্বর মাসে এ কাজ শেষ করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। অবশেষে এখন কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে রূপসা নদীর ওপর সাতটি স্প্যানসহ ৫.১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলসেতুর পুরোটাই দৃশ্যমান। ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর রূপসা রেলসেতুর পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ২৫ জুন সপ্তম ও শেষ স্প্যানটি বসে রূপসা রেলসেতুতে। রেলসেতুর ভায়াডাক্টের ৮৫৬টি পাইল বসানো হয়েছে। মূলসেতুর পাইল ৭২টি, পাইল ক্যাপ আটটি, বিয়ারিং ৩২টি সম্পন্ন হয়েছে। সেতুটির উপরিভাগ তৈরি করা হয়েছে স্টিলের গার্ডার এবং আরসিসি ডেকের সমন্বয়ে। এর মধ্যে রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করে লার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং রেল লাইন নির্মাণের কাজ করে ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।
এদিকে, এ প্রকল্পের ৯১ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে বসানো সম্পন্ন হয়েছে ৮৬ কিলোমিটার। এছাড়া ১১টি প্লাটফর্ম, ১০৭টি কালভার্ট, ৩১ ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডারপাসের সবগুলোই নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের ফুলতলা অংশে পরীক্ষামূলকভাবেও চলেছে রেল। সব মিলয়ে এখন পর্যন্ত খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯৮ শতাংশ। শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে রেলপথের ফিনিসিং এবং সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ চলছে।
ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনালের সুপার ভাইজার গৌতুম কুমার জানান, এখন আমরা একেবারেই শেষ সময়ের কাজ করছি। রেলপথ বসানো সম্পন্ন হয়েছে; এখন রেললাইনগুলো ডাম্পিং মেশিনের সাহায্যে সমান করা হচ্ছে; পাথরগুলো এক জায়গায় করা হচ্ছে; লেভেলিং ও রেলের বগির চাপ ঠিকভাবে যেন নিতে পারে সে কাজগুলো করা হচ্ছে। এ পর্যায় শেষ করা গেলেই সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে।
প্রকল্পটির নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাসুম হোসেন বলেন, ‘আমাদের আর মাত্র ২ শতাংশ কাজ বাকি। এ দুই শতাংশ কাজ মূলত ফিনিশিং ওয়ার্ক। অধিকাংশ কাজই শেষ হয়ে গেছে। আমাদের লক্ষ্য ছিলো সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করা। নির্ধারিত এ সময়ে আমরা কাজ শেষ করতে পারবো আশা করছি। সেপ্টেম্বরেই আমরা এ রেলপথে রেল লাইন চালাতে পারবো।
এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা প্রকাশ করে মোংলা কাস্টমস এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুলতান হোসাইন খান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ রেলপথের অপেক্ষায় রয়েছি। আর মাত্র কয়েক দিন পরই এ রেলপথ চালু হবে। এটি চালু হলে মোংলা বন্দর ব্যবহার করে আমরা খুবই অল্প খরচে পণ্য পরিবহন করতে পারবো।
‘সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে এ রেলপথটি আন্তর্জাতিক রুটে পরিণত হবে। মোংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভারতে যেতে পারবে, এতে সময় ও খরচ বাঁচবে। এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটবে। আমদানি-রফতানিকারকরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে।’
তিনি আরও জানান, ‘আমরা আশাবাদী হয়ে উঠছি, এ অঞ্চল দিয়ে দেশের অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।’
এদিকে এ রেলপথ চালু হলে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে জানিয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এ রেলপথ ঘিরে আমাদের নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমাদের এখন পাঁচটি জেটি আছে, যার প্রিতিটিতেই রেলপথটি সংযুক্ত। আমাদের আরও দুটি জেটি আগামী বছর নির্মাণ সম্পন্ন হবে। এ জেটি দুটিতেও রেলপথ সংযুক্ত করা হয়েছে। এ রেলপথ চালু হলে আমাদের মোংলা বন্দরের গতি আরও বাড়বে বলে আশা করছি।’
তিনি আরও বলেন, এ রেলপথ চালু হলে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানি বাড়বে। এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছি।
উল্লেখ্য, ভারতের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় খুলনা-মোংলা প্রকল্পে খরচ হচ্ছে ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪২:৪৩ ৪০ বার পঠিত