
রমজানুল মোবারক, বরকতময় মাস, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এই মাসে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের জন্য অসংখ্য রহমতের দরজা খুলে দেন, নেক আমলের প্রতিদান বাড়িয়ে দেন , জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুবর্ণ সুযোগ দান করেন। কিন্তু এই বরকতপূর্ণ সময়েও যদি মানুষ গীবত, মিথ্যা ও পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তবে তার রোজা শুধু ক্ষুধা-পিপাসার কষ্টে পরিণত হবে।
গীবত অর্থ কারও অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা শুনলে সে কষ্ট পাবে। কুরআন ও হাদিসে গীবতকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে? অবশ্যই তোমরা একে ঘৃণা করো।(সুরা হুজুরাত, ১২)
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
গীবত করা হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে। (সহিহ মুসলিম,২৫৮৯) অন্যদিকে, মিথ্যাও একটি ধ্বংসাত্মক পাপ, যা রমজানের পবিত্রতা নষ্ট করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ করল না, তবে তার খাওয়া-দাওয়া পরিত্যাগ করা আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য রাখে না। (সহিহ বুখারি, ১৯০৩) অর্থাৎ, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জন। যদি কেউ শুধু না খেয়ে রোজা রাখে, কিন্তু মিথ্যা, গীবত ও পাপ থেকে নিজেকে বিরত না রাখে, তবে সে রোজার আসল হক আদায় করতে পারেনি।
নবীজির (সা.) রমজান যেভাবে কাটাতে বলেছেন সেভাবেই কাটানো উচিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করতেন। ইবাদত-বন্দেগি, দান-সদকা, কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ সব কিছুতেই তিনি অধিক মনোযোগী হতেন। তিনি সাহাবাদেরও এ ব্যাপারে তাগিদ দিতেন।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
রমজান এমন একটি মাস, যার প্রথম দশক রহমতের, মধ্যম দশক মাগফিরাতের , শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির। (বায়হাকি) সাহাবায়ে কেরামও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই সুন্নাত মেনে রমজান কাটাতেন। তাঁরা রোজা রেখে শুধু খাবার-দাবার থেকে বিরত থাকতেন না, বরং তাদের জিহ্বা, চোখ, কান ও অন্তরকেও সংযত রাখতেন। হযরত উমর (রা.) বলেছেন,রোজা শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম নয়, বরং গীবত, মিথ্যা, অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকাই প্রকৃত রোজা।
রমজানুল মোবারকে গীবত ও মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। রমজান শুধু না খেয়ে থাকার নাম নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধির মাস। এই মাসে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের তাকওয়া অর্জনের সুযোগ দেন। তাই রোজার হক আদায় করতে হলে গীবত, মিথ্যা ও অনর্থক কাজ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
প্রথমত নিয়তের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে চিন্তা করা। রোজার শুরুতেই দৃঢ় নিয়ত করতে হবে, শুধু পানাহার থেকে নয়, বরং সকল গুনাহ থেকেও বিরত থাকবো। আল্লাহর অবিরাম নজরদারি ও জবাবদিহিতার কথা স্মরণ রাখতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারি, ৬০১৮)
দ্বিতীয়ত. কোরআনের সাথে সংযোগ বৃদ্ধি, রমজান কোরআনের মাস, তাই বেশি বেশি তিলাওয়াত করতে হবে। কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করতে হবে, যাতে গীবত ও মিথ্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি আসে। রমজান মাস, যাতে নাজিল হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়াত। (সুরা বাকারা, ১৮৫)
তৃতীয়ত, ইবাদত ও নেক আমল বৃদ্ধি করা, বেশি বেশি দোয়া করা, তাহাজ্জুদ পড়া ও জিকিরের মাধ্যমে জবানকে ব্যস্ত রাখা। মসজিদে সময় কাটানো, যাতে অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা যায়। রমজানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বেশি ইবাদত করতেন, আমরাও তাঁর আদর্শ অনুসরণ করবো।
চতুর্থত, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সংযম চর্চা, কথা বলার আগে ভাবতে হবে, এটি কি সত্য? এটি কি প্রয়োজনীয়? অনর্থক আলোচনা,ও হাসাহাসির আসর এড়িয়ে চলা। রাগ ও আবেগ সংযত রাখা, কারণ রাগের সময়ই মানুষ বেশি গীবত ও মিথ্যা বলে।
পঞ্চমত, ভালো পরিবেশ তৈরি করা, যেসব মানুষ গীবত ও মিথ্যা বলে, তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোচনা করা, যাতে গুনাহের আলোচনা না হয়। নেককার বন্ধুদের সঙ্গ গ্রহণ করা, যারা গীবত-মিথ্যা থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে।
ষষ্ঠত, দান-সদকা ও সেবামূলক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, রমজানে দান-সদকা বেশি বেশি করা, এতে আত্মার প্রশান্তি আসবে , গীবতের সুযোগ কমে যাবে। গরীব ও দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো, যাতে মনের মধ্যে অহংকার না আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে সবচেয়ে বেশি দান করতেন।
সপ্তমত, প্রতিদিন নিজের আত্মমূল্যায়ন করা, দিন শেষে নিজেকে জিজ্ঞাসা করা, আজ আমি কি কারো সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেছি? ভুল হলে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করা ,সংশোধনের চেষ্টা করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি নিজেও দিনে শতবার ইস্তিগফার করি। (মুসলিম, ২৭০২)
সবশেষ, মিথ্যা ও গীবত থেকে বেঁচে থাকার জন্য দোয়া করা, রমজানে মনের ভিতরের পরিবর্তন আনতে হলে দোয়ার বিকল্প নেই। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে, যাতে গীবত ও মিথ্যা থেকে আমাদের হেফাজত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দোয়া শিখিয়েছেন, উচ্চারণ, আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি আলা জিকরিকা, ওয়া শুকরিকা, ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা। অর্থ, হে আল্লাহ! আমাকে আপনার জিকির, শোকর ও সুন্দর ইবাদতের জন্য সাহায্য করুন। (আবু দাউদ, ১৫২২)
রমজান আমাদের জীবনের জন্য এক মহান শিক্ষার মাস। এই মাসের শিক্ষা হলো আত্মসংযম ও পবিত্রতা অর্জন। সুতরাং, শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং গীবত, মিথ্যা ও সব ধরনের পাপ থেকে বেঁচে থাকাই প্রকৃত রোজা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই রমজান যথাযথভাবে কাটানোর তাওফিক দান করুন , আমাদের রোজাকে কবুল করুন। আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ১২:২২:১৪ ৪ বার পঠিত