
মানবজাতি ইতিহাসের শুরু থেকেই নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। কখনো ধৈর্যের অভাবে, কখনো লোভের কারণে তারা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। নবীরা এসেছেন মানুষকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য। এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল বনি ইসরাইল জাতির সঙ্গে, যখন তারা নবী মুসা আ.-এর অনুপস্থিতিতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।
বনি ইসলাইলের একজন লোক সামিরি। তার ধোঁকায় পড়ে তারা স্বর্ণের বাছুরকে উপাস্য বানিয়ে নেয়। কিন্তু মুসা আ. ফিরে এসে কঠোরভাবে তাদের এই গোমরাহি দূর করেন এবং তাদের সত্য পথে ফিরিয়ে আনেন।
মুসা আ. আল্লাহর নির্দেশে তূর পাহাড়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তাকে তাওরাত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি চলে যাওয়ার পর তার সম্প্রদায়, বনি ইসরাইল, ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। শয়তানের প্ররোচনায় তারা সামিরি নামের এক ধূর্ত ব্যক্তির কথা বিশ্বাস করে। সামিরি স্বর্ণের গহনা গলিয়ে একটি বাছুর তৈরি করে এবং বলে, এটাই তোমাদের ইলাহ (উপাস্য)! বনি ইসরাইলের অনেকেই এই মূর্তিপূজা শুরু করে ফেলে।
এদিকে, তূর পাহাড়ে মুসা আ. আল্লাহর সাথে কথা বলে ফিরে আসছিলেন। আল্লাহ তাকে জানিয়ে দেন যে, তার সম্প্রদায় পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে। যখন মুসা আ. ফিরে এলেন, তখন তিনি দেখলেন যে তাঁর জাতি বাছুরের পূজায় লিপ্ত! তিনি প্রচণ্ড রাগান্বিত ও দুঃখিত হলেন।
তিনি বললেন, হে আমার জাতি! তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদের সাথে উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি? তোমরা কি এত দ্রুত ভুলে গেলে? নাকি তোমরা চেয়েছিলে যে, তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসুক?
মুসা আ. তখন তার ভাই হারুন আ.-এর শির ধরে টেনে বললেন,
তুমি কেন তাদের এ অবৈধ কাজে বাধা দিলে না? হারুন আ. বললেন, হে আমার ভাই! তারা প্রায় আমাকে মেরে ফেলেছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমার ফিরে আসার জন্য।
এরপর মুসা আ. সামিরিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেন এ কাজ করলে? সামিরি বলল, আমি যা দেখেছি, অন্যরা তা দেখেনি, তাই আমি এ কাজ করেছি। মুসা আ. সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বর্ণের বাছুরটিকে পুড়িয়ে গুঁড়ো করে পানিতে ছড়িয়ে দিলেন এবং সামিরিকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করলেন। তারপর তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে তওবা করতে বললেন, যাতে তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পায়।
এভাবেই বনি ইসরাইল এক বড়ো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, কিন্তু মুসা আ.-এর দৃঢ়তা ও আল্লাহর রহমতে তারা পুনরায় সঠিক পথে ফিরে আসে। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে বলেন,
فَرَجَعَ مُوۡسٰۤی اِلٰی قَوۡمِہٖ غَضۡبَانَ اَسِفًا ۬ۚ قَالَ یٰقَوۡمِ اَلَمۡ یَعِدۡکُمۡ رَبُّکُمۡ وَعۡدًا حَسَنًا ۬ؕ اَفَطَالَ عَلَیۡکُمُ الۡعَہۡدُ اَمۡ اَرَدۡتُّمۡ اَنۡ یَّحِلَّ عَلَیۡکُمۡ غَضَبٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ فَاَخۡلَفۡتُمۡ مَّوۡعِدِیۡ অর্থ: সুতরাং মুসা ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসল। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে একটি উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি? তারপর কি তোমাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে? না কি তোমরা চাচ্ছিলে তোমাদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ বর্ষিত হোক আর সে কারণে তোমরা আমার সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করেছ? (সুরা ত্বহা: ৮৬)
অর্থাৎ, আমার তূর পাহাড়ে গমনের পর তো এতটা লম্বা সময় গত হয়নি যে, তোমাদের ধৈর্য হারাতে হবে এবং আমার জন্য অপেক্ষা না করে এই বাছুরকে মাবুদ বানিয়ে নিতে হবে। ‘উত্তম প্রতিশ্রুতি’ দ্বারা তূর পাহাড়ে তাওরাত দেওয়ার ওয়াদা বোঝানো হয়েছে।
এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। কিভাবে ধৈর্যের অভাব মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও দৃঢ় ঈমানের মাধ্যমে ভুল সংশোধন করা সম্ভব। মুসা আ.-এর কঠোরতা শুধু শাস্তির জন্য ছিল না, বরং এটি ছিল এক মহামূল্যবান শিক্ষা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য বানানো ভয়ানক অপরাধ। অতএব, আমাদের উচিত সবসময় সত্যের ওপর অবিচল থাকা ও ধৈর্য ধরে সঠিক পথের অপেক্ষা করা।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৩:৫৮ ৬ বার পঠিত