মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রজনীকে উপমহাদেশে শবে মেরাজ নামে চিনে। এই রাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অলৌকিক উপায়ে উর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
মহানবী (সা.) সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় জিবরাইল (আ.) ও মিকাইলের (আ.) সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মেরাজের রাতে সফর করেন। তিনি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমানে গমন করেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে সপ্তম আসমান ও সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। পাশাপাশি জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
কোরআনে আল্লাহ এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন,
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا পবিত্র তিনি যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য। (সুরা বনি ইসলাই: ১)
ইসলামে মেরাজের বিশেষ গুরুত্ব আছে, কেননা এই মেরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান নির্দিষ্ট করা হয়।
মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ও ইতিহাস
হিজরতের পূর্বের কথা। এক রাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) শুয়েছিলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন, চোখদুটো লেগে এসেছে। তবে হৃদয়-মানস ছিল জাগ্রত। এরই মাঝে আগমন করলেন হযরত জিবরাঈল (আ.)। তিনি নবীজিকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন জমজমের নিকট। একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হলো। তা ছিল ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ; তাতে জমজমের পানি। জিবরাঈল (আ.) নবীজির বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করলেন। বের করে আনলেন নবীজির হৃদয়। যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে আবার প্রতিস্থাপন করে দিলেন আগের জায়গায়। ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেয়া হয় নবীজির কলব।
এরপর আনা হলো নবীজিকে বহন করার জন্য সওয়ারী। প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট। নাম বুরাক। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির, যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায়।
আল আকসায় নবীজি
এভাবে নবীজি (সা.) মুহূর্তেই পৌঁছে গেলেন বাইতুল মুকাদ্দাস বা আল আকসায়। বুরাক বেঁধে রাখা হলো পাথর ছিদ্র করে। যে পাথরে অপরাপর নবীগণ নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। নবীজি সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় জিবরাঈল (আ.) নবীজির সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন। একটি দুধের অপরটি শরাবের। নবীজি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। জিবরাঈল (আ.) বললেন, আপনি দ্বীনের স্বভাবসিদ্ধ বিষয়টি নির্বাচন করেছেন।
নবীজি মদের পেয়ালা নেয়ার পরিবর্তে দুধের পেয়ালা গ্রহণ করায় জিবরীল (আ.) বলেন, আপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন তাহলে আপনার উম্মত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৯৪)
আসমানসমূহে নবীজির গমন
শুরু হলো ঊর্ধ্বজগতের সফর। জিবরাঈল নবীজিকে নিয়ে চললেন। প্রথম আসমানে গিয়ে আওয়াজ দিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো, কে? বললেন, জিবরাঈল। জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞাসা করা হলো, তার কাছে কি আপনাকে পাঠানো হয়েছে? বললেন, হাঁ। এরপর নবীজিকে সম্ভাষণ জানানো হলো- মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে! খুলে দেওয়া হলো নবীজির জন্য আসমানের দরজা।
নবীজি প্রথম আসমানে গেলেন। সেখানে ছিলেন হযরত আদম (আ.)। জিবরাঈল পরিচয় করিয়ে দিলেন। নবীজি আদমকে সালাম বললেন। নবীজিকে সাদর অভিবাদন জানালেন- মারহাবা, নেককার পুত্র ও নেককার নবী। নবীজি দ্বিতীয় আসমানে দুই খালাত ভাই হযরত ঈসা (আ.) ও ইয়াহইয়া (আ.)-কে দেখতে পেলেন। তৃতীয় আসমানে দেখলেন হযরত ইউসুফ (আ.) কে। চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো নবীজির। পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন (আ.) ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা আ. সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম আ.-এর সাথে দেখা হলো। জিবরাঈল আ. পরিচয় করিয়ে দিলেন- ইনি আপনার পিতা, সালাম করুন। নবীজি হযরত ইবরাহীম আ.-এর সাথে সালাম বিনিময় করলেন। প্রত্যেক নবীরাই মুহাম্মদ সা. এর জন্য মনভরে দোয়া করলেন।
এরপর নবীজিকে নিয়ে যাওয়া হয় বাইতুল মামুরে। যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা আসে। এরপর এই সত্তর হাজার আর ফিরে আসে না। এভাবে প্রতিদিন সত্তর হাজার করে ফেরেশতাদের নতুন নতুন কাফেলা আসতে থাকে। এরপর গেলেন সিদরাতুল মুনতাহার দিকে। সেখানে আছে একটি কুল বৃক্ষ। যার একেকটি পাতা হাতির কানের মতো। আর একেকটি ফল মটকার মতো বড় বড়। যখন ওটাকে আল্লাহর বিধান আচ্ছন্ন করে নিল তা পরিবর্তিত হয়ে গেল। সৃষ্টির কারো সাধ্য নেই তার সৌন্দর্যের বিবরণ দেবার। জিবরাঈল বললেন, এটা সিদরাতুল মুনতাহা। এখানে চারটি নহর। দুটি অদৃশ্য আর দুটি দৃশ্যমান। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, দৃশ্যমান নদীদুটি কোনগুলো? জিবরাঈল বললেন, অদৃশ্যমান দুটি জান্নাতে। আর দৃশ্যমান দুটি হলো নীল নদ ও ফুরাত নদ।
পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ
আল্লাহ তাআলা নবীজিকে দিনরাতে উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিলেন। নবীজি আল্লাহর পক্ষ থেকে নামাজের এ হাদিয়া নিয়ে ফেরত আসছিলেন; এর মধ্যে দেখা হযরত মূসা আ.-এর সাথে। হযরত মূসা আ. জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ আপনার উম্মতের জন্য কী দিয়েছেন? নবীজি বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ। হযরত মূসা বললেন, আপনার উম্মত রাত-দিনে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবে না। আপনার আগে আমি উম্মতদের মধ্যে ছিলাম দুনিয়ায়। আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে নামাজ আরও কমিয়ে আনেন।
নবীজি সে মতে আল্লাহর কাছে গিয়ে কম করে দেওয়ার দরখাস্ত করলেন। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। এভাবে কয়েকবার আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে দরখাস্ত করতে করতে উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্তে কমিয়ে আনেন নবীজি। শেষবার আল্লাহ বলেন, মুহাম্মদ! এই হলো দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। প্রত্যেক নামাজের বিনিময়ে দশ নামাজের সাওয়াব। এভাবে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব পাবে। কেউ কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা করবে কিন্তু করতে পারবে না, তার জন্যও নেকি রয়েছে; এক নেকি। আর যদি ভালো কাজটি করে তাহলে তার জন্য দশ নেকী। আর কেউ কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করলে কোনো গুনাহ লেখা হবে না। তবে তা করে বসলে একটি গুনাহ লেখা হবে।
নবীজি এ সওগাত নিয়ে ফেরত আসছিলেন। হযরত মূসার সাথে দেখা হলো। মূসা আ. এবার শুনে বললেন, আপনি যান, আরো কমিয়ে আনুন। আপনার উম্মত পারবে না। বনী ইসরাঈলের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। নবীজি বললেন, আমার আর কিছু বলতে লজ্জা হচ্ছে! (বুখারি, হাদিস: ৩৮৮৭; মুসলিম, হাদিস: ১৬২, ১৬৪) নবীজিকে যখন বুরাকে তোলা হচ্ছিল তখন বুরাক ঔদ্ধত্য দেখাল। তখন জিবরাঈল আ. বললেন, মুহাম্মাদের ক্ষেত্রে এরকম করছিস! তোর উপর তো এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ কোনোদিন চড়েনি। এ শুনে বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৩১)
নবীজির জন্য জান্নাতি উপহার
আল্লাহ তাআলা নবীজির জন্য যে বিশেষ উপহার হাউজে কাউসার রেখেছেন। প্রথম আসমানে নবীজিকে তা দেখানো হয়। নবীজি সেই কাউসারের বিবরণও দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ৭৫১৭)
নবীজি (সা.) যখন প্রথম আসমানে যান- দেখেন এক ব্যক্তি, তার ডান পাশে কিছু রূহ আর বাম পাশে কিছু রূহের কাফেলা। তিনি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বাম দিকে তাকালে কাঁদেন। তিনি নবীজিকে সম্ভাষণ জানালেন। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল! ইনি কে? জিবরাঈল বললেন, ইনি আদম আ.। আর তার দুই পাশে তার সন্তানদের রূহ। ডানদিকেরগুলো জান্নাতী আর বামদিকেরগুলো জাহান্নামী। এজন্য তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন আর বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৪২)
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৯:২৯ ১ বার পঠিত