ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলার রোগীদের ভরসাস্থল।
কিন্তু সমস্যায় জর্জরিত এ হাসপাতালটি যেন নিজেই রুগ্ন। একদিকে জনবল সংকটে ধুঁকছে, অন্যদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই অচল। চিকিৎসক ও জনবল সংকটের পাশাপাশি পরীক্ষা এবং ওষুধের অপর্যাপ্ততাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় জোড়াতালি দিয়ে চলছে হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা।
বিগত দুই বছরের অধিক সময় যাবৎ হাসপাতালের গাইনী ও নাক-কান-গলা (ইনএনটি) বিভাগে কোন সিনিয়র কনসালটেন্ট নেই। কখনো মেডিকেল অফিসার কিংবা জুনিয়র কনসালটেন্ট দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনিশিয়ান।
হাসপাতালের সূত্র অনুয়ায়ী, হাসপাতালের ২৫১ টি পদের বিপরীতে জনবল রয়েছে ২০৪ জন। শূন্যপদ রয়েছে ৪৭ টি। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার ৪১ টি পদের মধ্যে ৭টি পদ শূন্য। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ১৪১ পদের বিপরীতে ১৬ টি পদ খালি রয়েছে৷ ৩য় শ্রেণির কর্মচারীর পদে খালি না থাকলেও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর ৪৩ পদের মধ্যে ২৪ টি পদ খালি রয়েছে। হাসপাতালের বিভিন্ন পদে আউট সোর্সিং হিসেবে কর্মরত রয়েছে ২৯ জন। যার মধ্যে অধিকাংশই ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কতৃক জানা যায়, হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র কনসালটেন্ট পদে তিনটি শূন্য পদ রয়েছে। হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট, ইএনটি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ও প্রসূতি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট পদে কোন চিকিৎসক নেই। এছাড়াও সার্জারী, অর্থো সার্জারী ও রেডিওলজি বিভাগে নেই কোন জুনিয়র কনসালল্টেন্ট , সিনিয়র স্টাফ নার্স ১৪ টি, সেবিকা/সেবক পদে দুটি পদ শূন্য।
একদিকে জনবল সংকট অন্যদিকে হাসপাতালের ফার্মেসীতে সংকট রয়েছে ওষুধের । প্রতিবছর এম. এস. আর এর মাধ্যমে ওষুধ ক্রয় করা হয়। যার মধ্যে ৬৫ শতাংশ এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানী লিমিটেড (ইডিসিএল) এর মাধ্যমে ওষুধ সংগ্রহ করা হয় ও ৩৫ শতাংশ টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়। কিন্তু হাসপাতাল ফার্মেসী থেকে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লেখা ওষুধের আংশিক পাওয়া যায় বলে অভিযোগ করেন রোগীরা।
সম্প্রতি হাসপাতালের একাধিক বিভাগে ঘুরে দেখা মিলে রোগীদের ভোগান্তির একাধিক চিত্র।
হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন সেলিনা পারভীন (২৯)। তিনি ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছেন। ডাক্তার তাকে এন্টিবায়োটিকসহ একাধিক ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেন। হাসপাতালের ফার্মেসীতে গিয়ে ব্যবস্থাপত্র দিলেন তিনি। সেখান থেকে দেওয়া হলো প্যারাসিটামল । ফার্মেসীতে দায়িত্বরত কর্মী জানান, প্যারাসিটামল ব্যতীত অন্য ওষুধ বাহিরের ফার্মেসী থেকে ক্রয় করতে হবে।
এ বিষয়ে আক্ষেপ নিয়ে সেলিনা পারভীন বলেন, এন্টিবায়োটিক এর মতো দামি ওষুধ যদি কেনার টাকাই থাকত তাহলে কি সরকারি হাসপাতালে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন ধরে চিকিৎসা করাই! মাস শেষ, ওষুধ যে কিনব সে টাকা নাই।
হাসপাতালের রোগ পরীক্ষা নিরীক্ষাতেও রয়েছে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা। রোগীদের অধিকাংশ পরীক্ষা করতে হয় প্রাইভেট হাসপাতালে। জানা যায়, সকাল ১০ টার পরে গিয়ে হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাফি করা যায় না। রোগীরা বাধ্য হয়ে তখন প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করে। একই পরিস্থিতি রোগ নির্ণয়ের অন্য বিভাগেও। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বন্ধ হয় এসব বিভাগ।
ক্ষোভ প্রকাশ করে হাসপাতালে আগত জুয়েল মিয়া বলেন, হাসপাতালগুলোতে এখন কাঙ্ক্ষিত সেবার ন্যূনতমও পাওয়া যায় না। আমার মা গ্রাম থেকে আসছে চিকিৎসা করতে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আলট্রাসনো করতে গেলাম। ১১ টা বাজেই বলল আলট্রাসনো করার সময় শেষ। বাধ্য হয়ে বাহিরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট করাইলাম।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে জানান , হাসাপাতালের আলট্রাসাউন্ড মেশিন কার্যক্ষমতা কম বিধায় পরীক্ষা কম করা হয়।
হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসা সেবার সময় সকাল ৮ টা থেকে দুপুর আড়াইটা। তবে ঘড়ির কাটায় ১টা বাজলেই টিকেট কাউন্টার ক্লোজড। একই চিত্র প্রায় সকল ডাক্তারের কক্ষেও। বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসা সেবা। ডাক্তার কক্ষে থাকলে সে সময় চলে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ সঙ্গে আলাপচারিতা।
বন্দরের কলাগাছিয়ার ইউনিয়নের বাসিন্দা মামুন। তিনি টিকেট কাউন্টারে নিজের শারীরিক সমস্যার কথা জানিয়ে টিকেট চাইলে তাকে টিকেট বিক্রির সময় শেষ বলে জানানো হয়। চিকিৎসা না নিয়ে ফেরার পথে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, বোর্ডে ঝুলানো আছে আড়াইটা পর্যন্ত ডাক্তার দেখানো যাবে। তাহলে ১ টার দিকে এসে ডাক্তার দেখাইতে পারলাম না। এটা কেমন হইলো? বোর্ডে লিখে রাখুক, ১ টার পরে আসলে চিকিৎসা দেওয়া হবে না।
বহির্বিভাগের সময় পেরুলেই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী রোগীদের। জরুরি বিভাগ থেকে কোন গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়না। রেফার্ড করা হয় অন্য হাসপাতালে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন কর্মচারী এ বিষয়ে বলেন, হাসপাতালে গাইনী বিভাগের ডাক্তারের সংকট রয়েছে। সিজার করতে হলে রোগীকে সকালে এসে ডাক্তারের কক্ষে যোগাযোগ করতে হয়। পরে সিরিয়াল বা নির্দিষ্ট সময় জানানো হয়। কিন্তু ইমার্জেন্সিতে কোন গাইনী ডাক্তার হাসপাতালে থাকে না। দুপুরের পর সিজারের জন্য কোন ইমারজেন্সি প্রসূতি রোগী দেখা হয়না। জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসাররা থাকেন। তখন রোগীদের অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) জহিরুল ইসলাম হাসপাতালের নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার বিষয়ে বলেন, আমাদের হাসপাতালে আসা রোগীদের আমরা যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে হাসপাতালের জনবল ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার সরঞ্জাম সংকট রয়েছে। এর ফলে আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছি না। এছাড়াও হাসপাতালে প্রয়োজন নিরাপত্তা রক্ষীদের। নিরাপত্তা রক্ষীর অভাবে হাসপাতালে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন এ এফ এম মশিউর রহমান হাসপাতালের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে কয়েকটি বিভাগে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও কনসালট্যান্ট আছে, তবে সিনিয়র কনসালট্যান্ট নেই। বদলিজনিত কারণে শুন্য রয়েছে। এ কারণে মেডিকেল অফিসার দিয়ে ওইসব বিভাগে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। চিকিৎসা তো দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে আমরা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পেয়ে থাকি। তবে কেন রোগীদের বাহির থেকে এন্টিবায়োটিকসহ অধিকাংশ ওষুধ ক্রয় করতে হয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইডিসিএল সারা বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সাপ্লাই করে। তারা এতো চাপের কারণে সব ওষুধ দিতে পারে না। তবে আমাদের হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিবায়োটিক ওষুধ আছে। এন্টিবায়োটিক রোগীদের বাহিরের ফার্মেসী থেকে কেনার কথা নয়। এমন হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৬:২৩ ২ বার পঠিত