বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ হবে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশে দেয়া অভিভাষণে একথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।
ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ন্যায় বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। তাই নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধের নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দূর্গে পরিণত হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে।’
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।
রেফাত আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার বিভাগে গুণগত পরিবর্তন আনয়নে অন্যতম কাজ হবে বিচারকগণের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে একটি যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জুডিশিয়াল কলেজিয়াম ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ করেন। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি ন্যায় বিচারের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। এ উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে জেলা আদালতসমূহের জন্য স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও পরিচালন বাবদ যে বাজেট চাইবে সরকারকে তা প্রদান করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে আমরা আশা প্রকাশ করছি বিচার বিভাগ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছবে।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করতে হবে। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে কখনো স্বৈরাচার সৃষ্টি হবে না; আইনের শাসন নিশ্চিত হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট ব্যারিস্টার সালাউদ্দিন দোলন বলেন, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ করে স্বাধীন করতে প্রধান বিচারপতির পরিকল্পনা ও উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে পূর্ব শর্ত হলো আলাদা বাজেট নিশ্চিত করা। ফলে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাসহ যাবতীয় কার্যক্রম ও পদক্ষেপ গ্রহণে কোনরূপ সীমাবদ্ধতা থাকবে না। তিনি বলেন, বিচারকদের পরাধীনতার মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। বিচারকগণ তার বিবেক, সংবিধান ও মহান সৃষ্টিকর্তার ভয় এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে পরিচালিত হবেন।
তিনি বলেন, মানুষের প্রথম ও শেষ আশ্রয়স্থল হলো বিচার বিভাগ। বিচারকগণ স্বাধীন ও সার্বভৌম তারা অন্য সাধারণ মানুষের মতো নন। বিচারক নিয়োগে আইন করার পরও অন্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ভারতে চলমান কলেজিয়াম সিস্টেম বিচারক নিয়োগ অনুসরণ করা যেতে পারে। ভারতীয় জুডিশিয়াল কলেজিয়াম ব্যবস্থা, যেখানে বিদ্যমান বিচারকরা দেশের সাংবিধানিক আদালতে বিচারক নিয়োগ করেন।
সুপ্রিম কোটের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের সংস্কার ও স্বাধীনতা নিয়ে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। যদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়।
তিনি বলেন, বিগত সরকার বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। বিচারপতি নিয়োগের আইন হওয়া দরকার। এছাড়া দলীয় বিবেচনা ও তদবির এসবের লাগাম টানা দরকার। নইলে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে। বিচার বিভাগে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এজন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় করে নি¤œ আদালতের বিচারকদের সব কিছু সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে গত ১১ আগস্ট শপথ নেন বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশ্য ২১ সেপ্টেম্বর অভিভাষণ দেন প্রধান বিচারপতি। ১৭ পৃষ্ঠায় দেয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের সংস্কার, পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ তুলে ধরেন।
এরআগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবীর মুখে ১০ আগস্ট দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। শপথের তারিখ থেকে তার এই নিয়োগ কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
ইতোমধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরমধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:২৫:১৯ ১৪ বার পঠিত