নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মিছিল থেকে গুলিবর্ষণের একটি ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যে মিছিল থেকে বিভিন্নজনের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রদর্শন ও প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা গেছে অনেককেই। এ ঘটনায় শামীম ওসমানসহ অস্ত্রধারী ও গুলিবর্ষণকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ভিডিওটি যারা পোস্ট করেছেন তাদের দাবি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে শামীম ওসমান দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী নিয়ে মিছিলটি করেছেন। সেই মিছিল থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর এতোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।
প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু থেকে মোবাইল ফোনে ধারণ করা ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোডে শতাধিক ব্যক্তির একটি মিছিল দুই নম্বর রেল গেট এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মিছিলকারীদের অধিকাংশ ব্যক্তিকে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে সামনের দিকে দৌড়াতে দেখা যায়। কারো কারো দুই হাতে দুটি করে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা যায়। ভিডিও ফুটেজে এক পর্যায়ে দেখা যায়, মিছিলকারীদের কয়েকজন অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করছেন। একের পর এক গুলির শব্দে তখন কেঁপে উঠে নারায়ণগঞ্জ শহর।
জানা গেছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া থেকে ডিআইটি এলাকা পর্যন্ত ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনের নেতৃত্বে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সে সময় সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীসহ আহত হন অন্তত অর্ধ শতাধিক মানুষ।
আরও পড়ুন: নারায়ণগঞ্জে শেখ হাসিনা, কাদের, আসাদুজ্জামান ও শামীম ওসমানের নামে আরও দুই মামলা
শিক্ষার্থী ও জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে পরদিন ১৯ জুলাই বিকেলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের দুই শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে চাষাঢ়া রাইফেল ক্লাব থেকে সশস্ত্র মিছিল বের করেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। শ্যাওলা রঙের ফুল হাতা শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট পরিহিত শামীম ওসমানের সামনে ও পেছনে দেখা যায় অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে দুই যুবককে। ছাত্র জনতার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতেও দেখা যায় তাদের।
এসময় আশপাশের ভবনের ছাদ ও বারান্দা থেকে সেই ঘটনার ভিডিওচিত্র মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখেন অনেকেই। পরে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে সম্প্রতি সেই ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
জেলার শিক্ষার্থী সংগঠন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দাবি, ওইদিন শামীম ওসমানের মিছিল থেকে ছোড়া গুলিতেই শহরের নয়ামাটি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছর বয়সের শিশু রিয়া গোপ এবং মন্ডলপাড়া এলাকায় হোসিয়ারি শ্রমিক শরিফ নিহত হন। অবিলম্বে মিছিলের অস্ত্রধারী ও গুলিবর্ষণ কারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সহ অস্ত্রগুলো উদ্ধারের দাবি জানান তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা সমন্বয়ক ফারহানা মানিক মুনা সময় সংবাদকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ত্বকী, আশিক, চঞ্চল, বুলুসহ অজস্র হত্যাকাণ্ড দেখেছি। যেগুলোর হয়তোবা ভিডিও ফুটেজ আমরা পাইনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে আমরা শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করেছিলাম আমাদের ওপর কারা গুলি চালিয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী দেখেছে। সেই ফুটেজ এখন সবার হাতে হাতে। আমাদের আন্দোলন ঠেকাতে ক্যাডার বাহিনী প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করেছে। এতে আমাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনতা নিহত হয়েছে। কারা গুলি করে এতোগুলো মানুষকে হত্যা করেছে এটা এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমরা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি।’
গণসংহতি আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা সমন্বয়ক তরিকুল সুজন সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন ঠেকাতে সেই মিছিলে শামীম ওসমান, তার সঙ্গে তার ছেলে অয়ন ওসমান, তার ভাতিজা আজমেরী ওসমান, তার শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুসহ ক্যাডার বাহিনীর অন্যান্যরা ছিল এবং তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে। ভিডিওতে স্পষ্ট আমরা সেটা দেখতে পেয়েছি।’
শামীম ওসমানের নেতৃত্বে সেই মিছিলে অস্ত্রধারী ও গুলিবর্ষণকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করতে পুলিশের প্রতি দাবি জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, ‘আমরা পুলিশ প্রশাসনকে বলছি আপনারা তাদেরকে গ্রেফতার করুন এবং তাদের ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করুন।’
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান সময় সংবাদকে বলেন, ‘শামীম ওসমান, তার ছেলে, ভাতিজা, শ্যালক ও ক্যাডার বাহিনী নিয়ে শহরের চাষাঢ়া থেকে বঙ্গবন্ধু রোডের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সশস্ত্র মিছিল নিয়ে গেছে। তারা ছাত্র জনতার ওপর গুলি করেছে। কতগুলো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে যতোগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের জন্য সে-ই (শামীম ওসমান) দায়ী। তার (শামীম ওসমান) বিচার না হলে নারায়ণগঞ্জের এ ধরনের আরও গডফাদারের জন্ম হবে।’
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র জনতা নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা, শামীম ওসমান, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, শ্যালক বিসিবি’র সাবেক পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটু, শামীম ওসমানের অনুগত অস্ত্রধারী তথাকথিত সাংবাদিক যুগান্তর ও ডিবিসি চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি রাজু আহমেদসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আসামি করে এ পর্যন্ত জেলার ৭ থানায় ১১টি হত্যা মামলা করেছেন নিহতদের পরিবার।
তবে গত ১৯ জুলাই সদর থানাধীন শহরের নয়ামাটি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয় নি। অবিলম্বে এই শিশু হত্যার ঘটনায় মামলা দায়েরের দাবি জানান জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
শামীম ওসমানের সশস্ত্র মিছিল থেকে অস্ত্র প্রদর্শন, গুলিবর্ষণ ও মানুষ হত্যার ব্যাপারে রাজনৈতিক এই নেতাদের দাবিগুলোর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল।
তবে সার্বিক বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার সময় সংবাদকে বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্থানে নিহতদের ঘটনায় জেলার সবগুলো থানায় ইতোমধ্যে একাধিক করে অনেকগুলো মামলা হয়েছে।মামলাগুলো আমলে নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। সবগুলো মামলার এজাহারনামীয় আসামিদের গ্রেফতার করতে আমাদের পুলিশের অভিযান ও তৎপরতা চলছে।’
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০০:১৯ ১৬ বার পঠিত