নদী দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোকে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি বলেন, ‘সবসময় শুনি সচেতনতা বাড়াতে হবে। যথেষ্ট হয়েছে, এখন আমাদের থামতে হবে। এখন ইমপ্লিমেন্টেশনে যেতে হবে, অ্যাকশনে যেতে হবে, জরিমানা করতে হবে।’
মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে ‘নদীতে শিল্প দূষণ রোধে করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই কথা বলেন।
বাংলাদেশে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) এই সেমিনারের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে বেলা জানায়, শীতলক্ষ্যা নদীর দুইপাড়ে ১১০ কিলোমিটারজুড়ে ২ হাজারেরও অধিক ছোট-বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প কারখানার ক্যামিকেলযুক্ত অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি শীতলক্ষ্যা নদী দূষণ করছে। ২০২২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ১১২টি শিল্প কারখানার তালিকা প্রকাশ করে যারা ইটিপি ব্যবহার করে না।
অনুষ্ঠানে আইভী বলেন, ‘আমরা নারায়ণগঞ্জ মূলত ‘ব্লু সিটি’। আমরা খাল, বিল, নদীর মানুষ। শীতলক্ষ্যার সাথে সাতটি নদীর সংযোগ। আমাদের ২৬টি খাল আছে, অসংখ্য পুকুর আছে। আমাদের ‘পিংক সিটি’ না ‘ব্লু সিটি’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা আমাদের পরিবেশের মর্যাদা বুঝতে পারছি না। ২১ বছর ধরে শুনছি শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কাজ এগিয়েছেও অনেক কিন্তু অ্যাকশনে কেউ যাচ্ছে না।’
‘আজকে সিঙ্গাপুর সফল হয়েছে, তাদের ভালো পরিকল্পনা ছিল। তারা কে প্রেসিডেন্ট, কে পথের ভিখারি এইটা দেখে নাই, আইনের প্রয়োগ করেছে। খালি লোকবল নাই বললেই হবে না। আপনার কাজটি আপনি করেন। একই কাজ সবগুলো দপ্তরের করলে তো হবে না। সমন্বয় করে কাজ করেন। ইটিপি ব্যবহার না করলে সেসব বর্জ্য যেন নদীতে ফেলতে না পারে সেই ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজনে কারখানা বন্ধ করে দেন।’
রাজধানীকে বাসযোগ্য করতে হলে তার আশেপাশের শহরগুলোকে রক্ষা করতে হবে জানিয়ে নাসিক মেয়র বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, সাভার, টঙ্গি, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রাজধানীকে বাঁচাতে হলে আশেপাশের এই শহরগুলোকে বাঁচাতে হবে। এইটা সবাই জানি কিন্তু কেউ অ্যাকশনে যাচ্ছি না। অ্যাকশনে যাবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। কিন্তু প্রতিবারই লোকবল নাই, পরিমাপ করতে হবে, নদী কমিশনের ক্ষমতা নাই, তারা কেবল সমীক্ষা করবে; এইসব বলা হয়। তাহলে কাজ করবে কে? যদি কাজ না করে তাহলে এত সংস্থার তো কোনো প্রয়োজন নাই।’
স্থানীয় সরকারের সাথে সমন্বয় করে সরকারি দপ্তরগুলোকে কাজ করার তাগিদ দেন তিনি।
আইভী বলেন, ‘সরকারি দপ্তরগুলো স্থানীয় সরকারকে সহযোগিতা করে না। নদী নিয়ে হাইকোর্টের রায় হয়েছিল, নদীর পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলো সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদকে হস্তান্তর করতে হবে। সেইসব জায়গায় সবুজায়ন, খেলার মাঠ ও জনস্বার্থে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের হাইকোর্টের সেই আদেশ কেউ প্রতিপালন করেনি। আমরা বারবার নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, সভা হয়েছে কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ সেসব জায়গা দেয়নি। বাধ্য হয়ে অনেক সময় দখল করে জনস্বার্থে কাজ করতে হয়। রেলওয়ের জায়গা দখল করে রাসেল পার্ক করেছি, বিআইডব্লিউটিএ’র জায়গা দখল করে পার্ক করেছি এবং নদীর পাড়ে গাছ লাগিয়েছি। এইটা করতে হতো না যদি বিআইডব্লিউটিএ হাইকোর্টের নির্দেশনা মানতো।’
সিটি কর্পোরেশনগুলোও নদী দূষণের জন্য দায়ি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ যখন পৌরসভা ছিল তখন সবার আগে বলেছি ড্রেনের পানিগুলো ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে চাই। আমাদের একটা পরিকল্পনা ছিল, কয়েকটা ড্রেনের মুখ একত্র করে অনেক গভীর একটি ড্রেন করবো এবং তার মুখে একটি ইটিপি স্থাপন করে পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলবো। কিন্তু এইটা নিয়ে কেউ সহযোগিতা করছে না, না আমাদের মন্ত্রণালয়, না ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, না এডিবি। এখন আমরা নিজেদের মতো করে উন্নয়ন কার্যক্রম করছি। কিন্তু টাকা তো পাচ্ছি না, ফান্ডের অভাব।
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা না করার আহ্বান জানিয়ে আইভী বলেন, ‘আমরা হয়তো মেগা প্রজেক্ট করছি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা নদী মেরে ফেলছি, শহর নষ্ট করে ফেলছি, বন উজার করে ফেলছি, গাছ কেটে ফেলছি। পরে দেখা যাবে পরিবেশ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে, দেশের অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে একটি টার্মিনাল করতে নদীর পাড়ে অনেকগুলো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এইসব গাছ রক্ষায় পরিবেশবাদী ও সংস্কৃতি কর্মীরা কয়েক সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন করলো কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ’র কেউ কোনো কর্ণপাত করলো না। উন্নয়নের প্রয়োজন আছে কিন্তু পরিবেশকে ধ্বংস করে নয়।’
নদী রক্ষা কমিশনের সহকারী পরিচালক সাকিব মাহমুদ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মতো শিল্পাঞ্চলে দূষণ রোধে জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। সেক্ষেত্রে প্ল্যাস্টিকসহ সকল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা যায় তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। ছোট দেশে উন্নয়ন প্রয়োজন কিন্তু পরিবেশ দূষণ করে না। দু’টাকে সমন্বয় করে এগোতে হবে। নদী একটি জীবন্তসত্তা, একে রক্ষা করতেই হবে।’
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘আমরা যারা সমাজ, সভ্যতার ইতিহাস পড়েছি সকলেই জানি সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং মানব বসতি নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এই নদীর পাড়ের মাটি আবার কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হতো। আমরা নদীমাতৃক বললেও বাংলাদেশ কিন্তু কৃষির দেশ। আমাদের সার্বিকভাবে চিন্তা করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাও করতে হবে। শুধু ফিল্ড ভিজিট বা আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে না। আমাদের সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে।
পরিবেশ আইন সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত। আমরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত, ভুক্তভোগী, আমাদের আয়ু কমে যাবে, আমাদের ক্যান্সার হবে কিন্তু আমরা কোনো অভিযোগ করতে পারবো না। দূষণকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারবো না। আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে মামলা করতে হবে। কে, কীভাবে পরিবেশ দূষণ করছেন সব আপনি দেখছেন, সব তথ্য আপনার কাছে আছে কিন্তু আপনি অভিযোগকারী হতে পারবেন না। এইটা কী আইন? এইটা তো জনবান্ধব বা পরিবেশবান্ধব আইন হতে পারে না।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ‘একটি নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠান’ বানিয়ে রাখা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘মানুষের হৃদপিন্ড যদি কাজ না করে সেই মানুষটা বাঁচে না। এই বায়ু, মাটি, পানি আমাদের হৃদপিন্ড। আমরা দেশের হৃদপিন্ডকে বাঁচাতে চাই। নাহলে আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই প্রিয় স্বদেশ জনমানবহীন হয়ে যাবে। ভবিষ্যত বংশধরদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। এইটা হতে দেওয়া যাবে না। লিমিটের বাইরে গিয়েও আমাদের কিছু করা উচিত। লোকবল কম, আইনে ক্ষমতা দেওয়া নাই; এইসব বললে হবে না। এতদিন তো খারাপ কাজের জন্য আইন ভঙ্গ করেছেন, এইবার ভালো কাজের জন্য আইন ভঙ্গ করেন’, যোগ করেন এএলআরডি’র পরিচালক।
শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ডাকা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কেউ এই অনুষ্ঠানে আসেননি জানিয়ে বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দেশের মানুষকে কাজে না লাগালে সারাজীবনই লোকবলের অভাব থাকবে। আমরা তো শুধু তালিকা চাই না। কী করলে সমাধান হবে সেইটা নিয়ে কাজ করতে হবে। একজনের ডাইং ফ্যাক্টরির জন্য আমি আমার নদী দূষণ হতে দেবো না, তার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য তো আমি আমার মায়ের হায়াৎ কমতে দেবো না। তার লাভের ভাগ তো আমাকে দিবে না, তাহলে লোকসানের ভাগ কেন আমি নেবো?
‘বাংলাদেশের ব্যাংক আইনে আছে, জনস্বার্থবিরোধী কোনো প্রকল্পে ব্যাংক অর্থ দেবে না। যে প্রতিষ্ঠানটা নদী ধ্বংস করছে সে তো অবশ্যই জনস্বার্থবিরোধী কাজ করছে। কমিউনিটি পর্যায়ে আমাদের আরও কিছু করতে হবে। ধরেন, পরিবেশ অধিদপ্তর এখন যা করছে পরে তাই করবে। কিন্তু আমাদের সমস্যা তো আমরা মুখ বুঝে মেনে নেবো না। নাগরিকদের পক্ষ থেকে ক্লিয়ার রোডম্যাপ সাজেস্ট করতে চাই যে, ১১২টা প্রতিষ্ঠানের দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ ও নদী রক্ষা কমিশনকে নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কমিউনিটি পর্যায়ে আমাদের আরও কিছু করতে হবে। দেশের মানুষকে কাজে না লাগালে সারাজীবনই লোকবলের অভাব থাকবে। শীতলক্ষ্যা নদীই যদি না থাকে তাহলে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য তো আর থাকলো না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদের আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে।’
এই সময় আরও বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক দিপু।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৭:১২ ১৬ বার পঠিত