ইসরায়েলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও ইউরোপের তিন দেশ—স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে মঙ্গলবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির একমাত্র পথ’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “স্পেন ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে গাজা এবং পশ্চিম তীরের সম্মিলিত একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম।”
আইরিশ প্রধানমন্ত্রী সিমন হ্যারিস এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা শান্তি প্রক্রিয়ার শেষে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে চেয়েছিলাম। তবে এখন আমরা স্পেন এবং নরওয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সেই স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম।”
ওদিকে, নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, “৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নরওয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অত্যন্ত সোচ্চার থেকেছে। আজ নরওয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়াটা নরওয়ে-ফিলিস্তিন সম্পর্কে একটি মাইলফলক।”
তিন দেশই বলেছে, তাদের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকেও একই পথে হাঁটতে উদ্ধুদ্ধ করবে বলে তারা আশা করছে।
গাজায় ৭ মাসের যুদ্ধের পর ইউরোপীয় দেশগুলোর এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল আরও একঘরে হয়ে পড়ছে বলেই মনে করছে।
জাতিসংঘের ১৯৩ টির মধ্যে প্রায় ১৪৩ টি দেশ এর আগে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর এখন ইউরোপের আরও তিন দেশের ফিলিস্তিকে স্বীকৃতির পদক্ষেপে এ সংখ্যা ১৪৬ টিতে দাঁড়াল বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেসে ম্যানুয়েল।
স্পেনের মাদ্রিদ, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন ও নরওয়ের অসলো এও বলেছে যে, তারা গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গতিশীল করতে চায়।
মঙ্গলবার সকালে আয়ারল্যান্ড মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে রাষ্ট্র হিসাবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি অনুমোদন করেছে। এ সময় দেশটির পার্লামেন্টের বাইরে ওড়ানো হয় ফিলিস্তিনের পতকা।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী দেশ আয়ারল্যান্ড ও স্পেন। আর ২৭-জাতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যদেশ সুইডেন, সাইপ্রাস, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্র, এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
পশ্চিম তীরের শাসনক্ষমতায় থাকা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ইউরোপীয় তিন দেশের স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। নরওয়েতে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এই পদক্ষেপ যুদ্ধ ও দখলদারিত্ব অবসানের পথে একধাপ অগ্রগামী পদক্ষেপ এবং ফিলিস্তিনের জনগণকে নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে মর্যাদা, স্বাধীনতা ও শান্তিতে বাস করতে দেওয়া এবং তাদের অত্বিস্তের অধিকার দেওয়ার পদক্ষেপ।”
ওদিকে, ইসরায়েল বরাবরই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার নিন্দা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এ পদক্ষেপ হামাসের হাতকেই আরও শক্তিশালী করবে। যে গোষ্ঠীটি গতবছর ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
ফিলিস্তিনকে ইউরোপীয় তিন দেশের রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ইসরায়েল এরই মধ্যে মাদ্রিদ, অসলো এবং ডাবলিন থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে। একইসঙ্গে ইসরায়েলে নিযুক্ত ওই তিন দেশের রাষ্ট্রদূতদের তলব করে ইসরায়েলে হামাসের হামলার ভিডিও দেখতে বলেছে।
পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জন্য স্পেনের কনস্যুলার সেবাও ইসরায়েল বন্ধ করে দিয়েছে। স্পেনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসকে সহায়তার অভিযোগ করেছে ইসরায়েল। জবাবে স্পেনও গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে ‘বাস্তবিকই গণহত্যা’ বলে সমালোচনা করেছে।
সম্প্রতি কয়েক মাসে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং ইইউ সদস্যদেশ মাল্টা ও স্লোভেনিয়াও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে।
তবে ফ্রান্স বলেছে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। আর ইসরায়েলের সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই অবস্থান নিয়েছে জার্মানি। দেশ দুটি এমন ‘একতরফা’ পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান কেবল সংলাপের মাধ্যমেই অর্জন করা যেতে পারে।
ওদিকে, আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নরওয়ের মতে, তারা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে অন্যান্য দেশগুলোও এগিয়ে আসে।তাদের যুক্তি, উভয় পক্ষই এক ধরনের রাজনৈতিক আবহকে লক্ষ্য ধরে নিয়ে এগুতে পারলেই কেবল বর্তমান সংকটের একটি টেকসই সমাধান হবে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ইউরোপীয় দেশের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি ও চলমান সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্র অপরিহার্য, যেখানে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়ই তাদের নিজস্ব সীমানা নিয়ে স্বাধীনভাবে পাশাপাশি অবস্থান করবে।
কিন্তু দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করে আসছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ২০২২ সালের শেষের দিকে নেতানিয়াহুর সরকারে কট্টর ডানপন্থি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দলগুলো যোগ দেওয়ার পর তার এই বিরোধিতা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪৩:৪৮ ৪২ বার পঠিত