প্রকৃতিতে এখন চলছে শীতের আমেজ। ভোরে প্রকৃতিতে কুয়াশার চাদর, শিশিরে সিক্ত ঘাস-পত্রপল্লব। শীতলতা ছুঁয়ে যায় দেহখানি। সেই সঙ্গে চলছে পিঠার উৎসব। পিঠার স্বাদ নিয়ে বাঙালিকে নতুন করে বলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ প্রধান খাদ্য ভাতের পরেই আয়োজন করে যে খাবারটি খাওয়া হয়, তা হলো পিঠা।
পিঠা বাংলার আদিম এবং আভিজাত্যপূর্ণ খাবার। বাঙালির লোক ঐতিহ্যে বিভিন্ন পিঠার ইতিহাস এক কালজয়ী সাক্ষী। এ দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ অন্য কোনো ঋতুর চেয়ে এই শীতঋতুতেই যেন বিভিন্ন ধরনের পিঠার উৎসবে করে থাকে। যুগ যুগ ধরে মানুষ সুস্বাদু উপাদেয় পিঠা খাদ্যদ্রব্যের উৎসব পালনও করে আসছে। ভোজনরসিক মাত্রই সেসব পিঠা পছন্দ করেন। শীতকালের বিকেলে কিংবা সকালের মিষ্টি রোদ পোহাতে পোহাতে নাশতা করার সময় শীতের পিঠার জুড়ি নেই।
বাঙালির খাবারের ইতিহাস ঘাঁটলে পিঠার অস্তিত্ব পাওয়া যায় অন্তত পাঁচশো বছর আগে থেকে। পুরোনো অনেক গল্প, লোকগাঁথায় উঠে এসেছে নানা পিঠার নাম। আর এ থেকেই বোঝা যায়, পিঠা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে।
স্বাদের যে কত রকম ভিন্নতা হতে পারে, তা সেসব পিঠা না চাখলে বোঝা সম্ভব নয়। কোনোটি হয়তো ডুবো তেলে ভাজা, কোনোটি আবার ভাপে তৈরি। কোনোটি শুকনো খোলায়, কোনোটি আবার দুধে ভেজানো। চিতই, ভাপা, পুলি, ছিটা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকন, লবঙ্গ লতিকা, বিবিখানা পিঠা, পোয়া পিঠা, মুঠি পিঠা, নকশি পিঠা, গোকুল পিঠা, সেমাই পিঠা ইত্যাদি প্রায় সব এলাকায়ই পরিচিত। এসময় সকালের নাশতায় কিংবা বিকেলের আড্ডায় শীতের পিঠা বেশ জমে।
কর্মব্যস্ত জীবনে প্রতিদিন ঘরোয়াভাবে পিঠা পুলির আয়োজন অনেকটাই অসম্ভব। পিঠা খাওয়ার সাধ সুযোগমতো না হয় পাড়ার গলির মোড়ের দোকান থেকে কিংবা পিঠা বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে খেয়েও মেটানো যাবে। কিন্তু বাড়িতে পিঠা বানিয়ে সবাই একত্রে পিঠা খাওয়ার আয়োজনের আনন্দ তো তাতে মিলবে না। আপনার পরিবার বা প্রিয়জনকে নিজেই পিঠা ঘরে বানিয়ে উপহার দিয়ে চমকে দিতে পারেন।
দুধপুলি পিঠা
উপকরণ
চালের গুঁড়া: আড়াই কাপ
ময়দা: আধা কাপ
পানি: দেড় কাপ
লবণ: আধা চা চামচ
ঘি: আধা চা চামচ
দুধ: দেড় কেজি
চিনি: স্বাদমতো ; ন্যূনতম এক কাপ
গুঁড়াদুধ: প্রয়োজন অনুসারে
কনডেন্সড মিল্ক: প্রয়োজনমতো
নারিকেল কোরানো: দেড় কাপ
এলাচ: ২/৩টি
প্রণালি
প্রথমে পিঠার ভেতরে থাকা পুরের জন্য দেড় কাপ নারিকেল কোরানো আলাদা করে রেখে দিন (সামান্য রেখে দিতে হবে পরে দুধের মধ্যে দেওয়ার জন্য)। এখন বাকি কোরানো বাকি নারিকেলের সঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় চামচ চিনি দিয়ে ফ্রাইপ্যানে সাত থেকে আট মিনিট ভেজে উঠিয়ে নিন (মূলত নারিকেলের পানি শুকাতে যতক্ষণ লাগে আরকি)। এই সদ্য প্রস্তুতকৃত পুর পিঠার ভেতরে দিতে হবে।
এবার দুধের সঙ্গে গুঁড়াদুধ, চিনি, কনডেন্সড মিল্ক আর এলাচ মিশিয়ে জ্বাল দিন। পিঠা বানানো হতে হতে দুধ খুব সুন্দর জ্বাল হয়ে হালকা রং হবে। এখন অন্য পাতিলে পানির সঙ্গে লবণ এবং ঘি একসঙ্গে দিয়ে গরম করুন। ফুটানো পানির সঙ্গে চালের গুঁড়া ও ময়দা একসঙ্গে দিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে চুলা বন্ধ করে দিয়ে খামির প্রস্তুত করে ফেলুন। রুটি বানানোর পিঁড়িতে গরম গরম খামির খুব ভালো করে মথে নিন।
এখন খামিরটা ১০ ভাগ করুন। এক একটি ভাগ দিয়ে ছোট ছোট রুটি বেলে অথবা হাত দিয়ে চেপে পাতলা করে ভিতরে নারিকেলের পুর দিয়ে পুলি পিঠা প্রস্তুত করুন। এভাবে সব পিঠা তৈরি করে নিন। এখন বানানো পুলি পিঠা, ফুটিয়ে রাখা দুধের মধ্যে দিয়ে চুলার আঁচ কম রেখে ১০ মিনিট রান্না করে ফেলুন।
হাঁড়ি আস্তে ঝাঁকিয়ে পিঠার সঙ্গে দুধ মিশিয়ে নিন। ১০ মিনিট রান্নার পর কোরানো নারিকেল দিয়ে আরও দুই থেকে তিন মিনিট রান্না করে নামিয়ে পাত্রে ঢেলে পরিবেশন করুন মজাদার দুধ পুলি পিঠা।
দুধ চিতই পিঠা
উপকরণ
টাটকা চালের গুঁড়া: ২ কাপ
চিনি: আধা কাপ
লবণ: স্বাদ মতো
এলাচ: ২টি
তেজপাতা: ১টি
নারিকেল অথবা বাদামকুচি: ২ টেবিল-চামচ
পানি: ১ কাপ
দুধ: ১ লিটার
প্রণালি
চালের গুঁড়ার সঙ্গে লবণ মিশিয়ে পানি দিয়ে গোলা তৈরি করে নিন। খেয়াল রাখবেন গোলা যেন ঘন বা পাতলা না হয়। গোলা ঠিক মতো না হলে পিঠায় ছিদ্র হয় না। সুবিধা মতো পাত্রে গোল আকারে চিতই বানিয়ে নিন। এবার ১ লিটার দুধে এলাচ, তেজপাতা আর চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে থাকুন। দুধ আধা লিটার হলে পিঠাগুলো এর মধ্যে ছেড়ে দিন। তারপর জ্বাল কমিয়ে দিন। আস্তে আস্তে পিঠায় দুধ ঢুকে নরম হয়ে ফুলে ফুলে উঠবে। এখন জ্বাল বন্ধ করে দিন। কয়েক ঘণ্টা রেখে দিন। পরিবেশনের আগে উপরে নারিকেল বা বাদাম ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
ক্ষীরসা পাটিসাপটা
ক্ষীরসা তৈরির উপকরণ
পাটিসাপটা পিঠার জন্য ক্ষীরসা বানাতে হয়। অথবা বাজারে ভালো মানের ক্ষীরসা সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। ক্ষীরসা তৈরির জন্য প্রয়োজন ১ লিটার দুধ, খেজুরের গুড় কিংবা চিনি পরিমাণমতো, ২ চামচ সুজি, নারিকেল বাটা বা কুড়ানো ৩ থেকে ৪ চামচ।
আটার গোলা বানানোর উপকরণ
চালের আটা বা গুঁড়া: ২ থেকে ৩ কাপ
ময়দা: ১ থেকে ২ কাপ
লবণ: সামান্য
গরম পানি: প্রয়োজন মত
প্রণালী
প্রথমে ক্ষীরাসা তৈরি করতে হবে। এজন্য একটি কড়াই বা প্যানে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করতে হবে। এরপর সুজি, খেজুরের গুড় বা চিনি, নারিকেল বাটা বা কুড়ানো একসঙ্গে দিয়ে ঘন ঘন নাড়তে হবে। ক্ষীরসা অনেক ঘন হয়ে গেলে নামিয়ে রাখতে হবে। এবার চালের গুঁড়া বা আটা নিয়ে তাতে ময়দা মেশান। এরপর গরম পানি দিয়ে খুব ভালভাবে মিক্স করুন। দেখবেন গোলা যেন খুব পাতলা বা ভারী না হয়। এখন একটি ফ্রাইপ্যানে তেল দিন। তেল গরম হওয়ার পর তাতে আটার মিশ্রণ দিন পরিমাণ মত, রুটির আকৃতি তৈরি করুন। এবার রুটিতে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ক্ষীরসা দিন। চামচ কিংবা হাতের সাহায্যে পুরো রুটিতে ক্ষীরসা মিশিয়ে নিন। তারপর একই রকম সাইজে মোড়াতে থাকুন। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল মজাদার ক্ষীরসা পাটিসাপটা পিঠা।
লবঙ্গ লতিকা
উপকরণ:
ময়দা দেড় কাপ, তেল ১ টেবিল চামচ, লবঙ্গ ১০-১২টি, সুজি ১ কাপ, ঘি ২ টেবিল চামচ, চিনি বা গুড় আধা কাপ (স্বাদমতো), কোরানো নারকেল আধা কাপ, লবণ সামান্য ও দারুচিনি ১ টুকরা।
প্রণালি
ময়দায় সামান্য লবণ ও তেল মেখে ডো তৈরি করুন। সুজি অল্প টেলে ধুয়ে নিন। ঘিতে দারুচিনি ভেজে তুলে নিন। সুজি, চিনি বা গুড়, কোরানো নারকেল দিয়ে ভেজে নামিয়ে নিন। ছোট ছোট রুটি বানিয়ে এর ভেতর সুজির পুর ঢুকিয়ে ভাঁজ করে লবঙ্গ দিয়ে আটকে দিন। ডুবো তেলে ভেজে নিন। গরম অথবা ঠান্ডা পরিবেশন করুন।
নকশি পাকন পিঠা
উপকরণ:
আতপ চালের গুঁড়া ২ কাপ, মুগ ডাল আধা কাপ, দুধ ২ কাপ, পানি ১ কাপ, ঘি ১ টেবিল চামচ, চিনি ১ কাপ ও পানি ১ কাপ। এ ছাড়া নকশা করার জন্য খেজুরের কাঁটা ও টুথপিক লাগবে।
প্রণালি
দুধের সঙ্গে পানি মিশিয়ে ফুটান। ফুটে উঠলে সামান্য লবণ চালের গুঁড়া দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে চুলা বন্ধ করে কয়েক মিনিট ঢেকে রাখুন। মুগ ডাল টেলে সেদ্ধ করে বেটে রাখুন। চালের গুঁড়ার ডো ভালোভাবে মথে এর সঙ্গে ডাল ও ঘি দিয়ে মাখুন। রুটি বেলে পিঠা কেটে নিন। খেজুর কাঁটা ও নকশা তৈরি করে ডুবো তেলে মাঝারি আঁচে ভাজুন। ভাজা পিঠা শিরায় দিয়ে তুলে নিন।
কাশ্মীরি ভাপা পিঠা
উপকরণ:
আতপ চালের গুঁড়া ২ কাপ, পোলাওর চালের গুঁড়া ১ কাপ, তরল দুধ ১ কাপ, পাটালি গুড় ১ কাপ, মাওয়া ৩ টেবিল চামচ, পেস্তাবাদাম ২ টেবিল চামচ, কাজুবাদাম ২ টেবিল চামচ, কিশমিশ ৩ টেবিল চামচ, কাঠবাদাম ২ টেবিল চামচ ও লবণ সামান্য।
প্রণালি
চালের গুঁড়ার সঙ্গে সামান্য লবণ ও দুধ মেখে কয়েক ঘণ্টা রেখে দিন। চালুনি দিয়ে চেলে নিন। ভাপা পিঠার ডাইসে সামান্য চালের গুঁড়া দিয়ে বাদাম, কিশমিশ, গুঁড়া মাওয়া দিয়ে আবার ওপরে চালের গুঁড়া দিয়ে হালকাভাবে চেপে ভাপা পিঠার পাত্রে পিঠা তৈরি করে নিন। গরম–গরম পরিবেশন করুন।
নারকেল গুড়ের মেরা পিঠা
উপকরণ:
আতপ চালের গুঁড়া ৩ কাপ, গুঁড় ২ কাপ, কোরানো নারকেল ১ কাপ ও লবণ সামান্য।
প্রণালি
আড়াই কাপের মতো পানিতে গুড় দিয়ে জ্বাল দিন। ফুটে উঠলে চালের গুঁড়া দিয়ে নাড়ুন, কোরানো নারকেল দিন। চুলা থেকে নামিয়ে কয়েক মিনিট ঢেকে রাখুন। এবার ভালোভাবে মথে নিন, গোল ছোট ছোট বলের মতো করে হাতের তালু দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পিঠা তৈরি করুন। ভাপে ১৫-২০ মিনিট রেখে নামিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে পরিবেশন করুন। মিষ্টি খেতে না চাইলে গুড় বাদ দিয়ে তৈরি করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪০:১৯ ৪০ বার পঠিত