পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৬ বছর পরও পাহাড়ে বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। এখনও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে চলছে সংঘাত। এই সংঘাতের কারণে পার্বত্য শান্তি চুক্তির দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও পার্বত্য জনপদের মানুষ শান্তিতে ঘুমতে এবং চলাফেরা করতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের সময়ে পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো অস্ত্র জমা দিলেও আজও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া চলছে প্রতিনিয়ত। পাহাড়ের চুক্তির পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনীর অপারেশন উত্তরণ জোরদার করার দাবি জানিয়ে আসছে। এ ছাড়া চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে সেনাবাহিনী যে উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করেছে তা আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। পাহাড়ের সাধারণ মানুষের দুর্যোগের সময় সেনাবাহিনীর অবদান চোখে পড়ার মতো।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিরাজমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়।
সরকার চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন করার কথা বললেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অনেক ধারা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতে পারেনি সরকার। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাহাড়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে শঙ্কা, ক্ষোভ আর হতাশা। এ ছাড়া চুক্তির পরও পাহাড়ে আঞ্চলিক কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও হানাহানি লেগে থাকায় শান্তি মেলেনি এই পাহাড়ি জনপদে। চুক্তির পর থেকে পাহাড়ের খুন, গুম অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ আনা অপকর্ম বিরাজ করছে।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের আগে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল একটি থাকলেও বর্তমানে পাহাড়ের ৫ থেকে ৬টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল বিরাজমান। দলগুলো হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেল পার্টি, কেএনএফ। এই সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে প্রতিনিয়ত পাহাড়ে সংঘাত লাগিয়ে রেখেছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র জমা দেন সন্তু লারমা। ছবি: এএফপি
আর চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। তাদের অভিযোগ, পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছর অতিবাহিত হলেও পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়ের মধ্যে ভূমি সমস্যার নিরসন না হওয়া, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট বিষয় হস্তান্তর ও নির্বাচন না হওয়া, পার্বত্য অঞ্চলে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে পাহাড়ে বসবাসরত সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রয়েছে নানা হতাশা ও বঞ্চনা।
রাঙামাটি সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন,
যাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করতে পেরেছি তাদেরকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। যারা চুক্তি করে, চুক্তির প্রতি তাদের চেয়ে আর কারও দরদ বেশি হতে পারে না। চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। তবে আমরা অকপটে স্বীকার করি শান্তিচুক্তির মূল ধারাগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয় নাই, বাস্তবায়িত হওয়া দরকার, পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা এবং সাহসের কারণে এই শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং তিনি আন্তরিক বলেই চুক্তির অধিকাংশ দফা বাস্তবায়নও হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব চুক্তির মধ্যেই কিছু জটিল দিক থাকে, যা বাস্তবতার আলোকে পারস্পরিক সমঝোতা ও সংলাপের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি রাখে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সেই বাস্তবতা সবাই অনুধাবন করতে পারে না।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সহ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ের সমস্যা কোনোদিনও সমাধান হবে না।
তিনি বলেন, ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্য সমস্যা, কিন্তু প্রধান অন্তরায় নয়। প্রধান অন্তরায় হলো আমাদের মধ্যে আর সরকারের মধ্যে একটা বোঝাবুঝির অভাব। তাই এটার কারণে শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকারের কী ভাবনা সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। সরকার যেভাবে যাচ্ছে সেভাবে যাবেন নাকি যথাযথ রাস্তায় আসবে।’
তিনি আরও বলেন, যতই সরকার সময় কালক্ষেপণ করবে, ততই দলবাজি হবে, নানা অস্ত্রবাজি হবে, নানা চাঁদাবাজি হবে, আরও দল গজিয়ে উঠবে। তখন শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে আরও বেশি জটিল রূপ ধারণ করবে। তাই আমরা চাই সরকার শান্তি চুক্তি যেসব ধারা বাস্তবায়ন হয়নি তা দ্রুত বাস্তবায়ন করে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বয়ে আনুক।’
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবুব রহমান বলেন, পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরে এসেও পাহাড়ে জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (প্রসীত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ (কেএনএফ) একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। চলছে অস্ত্রের মহড়া, মহা উৎসবে চলছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গুম, খুন ও অপহরণ। তাদের হাতে পাহাড়ি-বাঙালি সব জিম্মি। পার্বত্য চুক্তির শর্তানুযায়ী পাহাড় থেকে একটি ব্রিগেডসহ ২৩৮টি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে ৩০টি বিভাগ, রাঙামাটি জেলা পরিষদে ৩০টি বিভাগ ও বান্দরবান জেলা পরিষদে ২৮টি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চুক্তি করার সময় বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে তাদের অ-উপজাতি আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধায় উপজাতীয়দের নানা অগ্রাধিকার শর্তযুক্ত করে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা নিয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের চেতনা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও উন্নয়ন বিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তারা দেশি-বিদেশি ইন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ যে শান্তির আশা করেছিল মানুষের সে আশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দু’পক্ষকেই নমনীয় ভাব পোষণ করে এগিয়ে আসতে হবে। আর পাহাড়ের বিরাজমান সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ও জনসংহতি সমিতি দু’পক্ষই আলোচনা মাধ্যমে সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এমন প্রত্যাশা পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষের।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৯:২১ ৩৭ বার পঠিত