গ্যাং শব্দটা বর্তমান সময়ে বেশ আলোচিত। উঠতি বয়সের কিশোরদের নিয়ে গঠিত হয় এসব গ্যাং। নিজেদের পেশিশক্তির জানান দিতে তাদের ব্যবহার করে চালানো হয় নির্মম সন্ত্রাসী হামলা। আর সেই হামলায় খুন, রক্ত জখমের মতো অপরাধেরও তোয়াক্কা করে না গ্যাং সদস্যরা। ইদানীং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জেও উৎপাত বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত এ গ্যাংয়ের। যার ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে বড় ভাই নামক রাজনৈতিক নেতারা।
ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেকোনো নির্বাচন আসলেই রাজনীতির মাঠ সরগরম রাখে নেতাকর্মীরা। তবে ইতোমধ্যে রাজনীতিকে পুঁজি করে শান্তিপ্রিয় সিদ্ধিরগঞ্জকে অশান্ত করে তুলেছে দুটি ‘গ্রুপ’। নিজ এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখার লক্ষ্যে হামলা চালানো হয় নিরীহ মানুষের ওপর। নাসিকের ২ ও ৭ নং ওয়ার্ডের বসবাসরত প্রায় দেড় লাখ মানুষ সর্বক্ষণ আতঙ্কে জীবনযাপন করছে।
এলাকার বখাটে, মাদককারবারি/সেবনকারী ও উঠতি বয়সের ছাত্রদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এ দুটি গ্যাং। নিজেদের ফায়দার জন্যে কম বয়সি কিশোরদের হাতে তুলে দেয়া হয় মরণনেশা মাদক ও নানা ধরনের দেশি-বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র।
দুটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিসাব অনুযায়ী (নাসিক) ২ নং ওয়ার্ডে ২৪ হাজার ভোটার রয়েছে, তবে ওই এলাকায় জনসংখ্যা বসবাস করে প্রায় ১ লাখের মতো। এবং ৭ নং ওয়ার্ডের ভোটার ২১ হাজার হলেও জনসংখ্যা বসবাস করে ৫০ হাজারেরও অধিক।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এইসব গ্রুপ নেতারা ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়দাতা। তাদের পদ-পদবি না থাকলেও যেকোনো অপরাধে ব্যবহার করে আসছে দলের নাম। গোটাকয়েক সিনিয়র নেতার পকেট গরমে বনে গেছেন দল নেতা। যার কারণে রাগ/ক্ষোভে অনেক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন না ত্যাগী ও বর্ষিয়ান নেতাকর্মীরা।
সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জ থানাস্থ কয়েকটি এলাকায় ঘটেছে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ানক হামলার ঘটনা। ওইসব গ্যাংগুলো এখানে বিভিন্ন খিতাবী নামে বেশ পরিচিত। শুধু এই দুটি নন এর বাহিরেও নামে-বেনামে রয়েছে আরও কয়েকটি গ্রুপ। তবে আলোচনার শীর্ষে এরা।
গেল কয়েকমাসে বেপরোয়ায় বনে গেছেন ‘টেনশন গ্রুপ’, এটার নেতৃত্ব দেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদপ্রার্থী শফিকুল ইসলাম শফির ছেলে সীমান্ত। অপরটি সজু গ্যাং, যার নেতৃত্ব দেন খোদ সজু নামক ব্যক্তিই।
‘টেনশন গ্রুপের’ তাণ্ডবের বর্ণনা:
৩১ আগস্ট (নাসিক) ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও থানা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের বসতবাড়িে মধ্যরাতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কাউন্সিলরের দাবি ওই এলাকার পরিচিত গ্যাং টেনশন গ্রুপ লিডার সীমান্ত ও তার বাহিনীর সদস্যরা এটি ঘটিয়েছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বারের মতো ৫ সেপ্টেম্বর ফের তার বাড়িতে ওই টেনশন গ্রুপের বাহিনীরা হামলা চালান। পরদিন ৬ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকালে একলাছুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ীর বতসবাড়িতে হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা। ভুক্তভোগী একলাছুর রহমানের দাবি ২০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল। কিন্তু তাদের দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় তার বাড়িতে হামলা করা হয়েছে।
দুই দিন পর ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিবকে বেধড়ক মারধর করে ভাংচুর করা হয় অফিসে। তবে এ ঘটনা কোনো আইনি সহয়তা পাননি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ইকবাল হোসেন।
পরে ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোক্তার হোসেনের ‘স’ মিলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে এই গ্যাং। সর্বশেষ ২৮ সেপ্টেম্বর ওই এলাকার আলমগীর হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীর একটি কয়েল কারখানায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী জানিয়েছে সীমান্ত সশরীরে না থাকলেও তার সহযোগীরা হামলা করে। থানায় তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে একাধিকবার এই টেনশন গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বছর পিস্তল নিয়ে টিকটক করা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল এদের।
অপর গ্রুপ সজু বাহিনী, পুরো নাম তানজিম কবির সজু। বর্তমানে এই ব্যক্তি (নাসিক) ৭ নং ওয়ার্ড বাসিন্দাদের চোখে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। ওই এলাকায় তার রয়েছে বিশাল গ্যাং। সেসব বাহিনীর দ্বারা মানুষের উপর চালানো হয় নানা রকম অমানবিক নির্যাতন। বাহিনীটি হামলা করতে সময় নেন স্বল্পক্ষণ। তার হামলা থেকে রক্ষা পাননি অসহায় সহজসরল মোবাইল ব্যবসায়ীও। গত ২৯ জুলাই বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের সামনে পুলিশের সঙ্গে পাল্টা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল বিএনপির। সেসময় আওয়ামী লীগের হয়ে স্লোগান দিয়ে (নাসিক) ১ নং ওয়ার্ডের হিরাঝিল আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেন সজু তার গ্যাংয়ের সদস্যরা। ওইসয়ম মোবাইল ব্যবসায়ী সবুজ মিয়া ওরফে বাবু নামের এক নিরীহ ব্যক্তিকে অযথা মারধর করে রক্ত জখম করে তারা।
এর কিছুদিন আগে বসতবাড়ি দখল নেয়াকে কেন্দ্র করে কদমতলী গ্যাস লাইন এলাকায় সজু বাহিনীর সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে টুটুল নামের এক ব্যক্তির লোকদের সঙ্গে। সেসময় দু’গ্রুপের মধ্যকার অন্তত ১০ জন আহত হয়েছিল। সংঘর্ষকালে পোড়া হয়েছিল একটি ইয়ামাহা কোম্পানির সুজকি মোটরসাইকেলও।
সর্বশেষ ২৮ সেপ্টেম্বর কদমতলী গ্যাস লাইন এলাকার ফরহাদ নামক এক ব্যক্তির মার্কেটের ভাড়া দেয়া দোকানে তান্ডব চালিয়ে লুটপাট করার ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকার চৌধুরী বিলার মালিকের কাছে চাঁদা দাবি করায় তিনি থানায় অভিযোগ করেছে সজু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।
এলাকাবাসী অভিযোগ তুলে জানিয়েছেন, তানজিম কবির সজু ওয়াকিটকি ও অস্ত্রধারী নিয়ে মহড়া দেন এলাকাজুড়ে। তার ভয়ে আতঙ্কিত সেখানকার বাসিন্দারা। নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করায় নিরব ভূমিকায় রয়েছে প্রশাসনও।
এই দুটি এলাকায় ঘুরে ওইখানকার বসবাসকারী বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা হয়। তবে তারা নাম না প্রকাশ করা শর্ত দিয়ে জানান, এসব বাহিনীর সদস্যরা মাদক বিক্রি, জমি দখল করা ও বিভিন্ন বাড়িঘর ও কারখানা মালিকদের নির্যাতন করে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে থাকেন। বাড়ি করা বা জমি বিক্রি করলে চাঁদা দিয়ে হয় এদের। নাম প্রকাশে অনীহা কেন? জানতে চাইলে তারা বলে, নাম দিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হবে। ওদের বিরুদ্ধে মুখ খুললতেও আতঙ্কে থাকে এলাকাবাসী।
স্থানীয় লোকজন ও সমাজকর্মীদের ভাষ্যমতে, এইসব গ্যাংয়ের তান্ডব থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কেননা প্রশাসনকে জনগণের রক্ষক নামে ডাকা হয়।
অভিযোগের বিষয়ের সত্যতা জানতে সীমান্তর পিতা সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম শফিকে মুঠোফোনে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, তার ছেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট কথা ছড়িয়ে যাচ্ছে কিছুসংখ্যক মানুষ। সর্বশেষ হামলার ঘটনায় তার ছেলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ওই ঘটনার অভিযোগকারী আলমগীর তাদের কারো নাম উল্লেখ করেনি। রাজনৈতিক ভাবে তাকে হেয় করার জন্যে বিরোধী দলের থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সে এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
আরেক গ্যাং লিডার তানজিম কবির সজুর মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি কল রিসিভ করেনি।
নূরউদ্দিন নামের নারায়ণগঞ্জের এক সমাজকর্মীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, বর্তমান সময়ে অল্পতেই গ্যাং তৈরি হয়। সিদ্ধিরগঞ্জ শিল্প বানিজ্যিক থানা হওয়ায় ওইখানে অস্থায়ী মানুষরা এসে বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছে। তবে তারা কিছুসংখ্যক লোকের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে থাকে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এমন কর্মকান্ড করার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেনো আতিনেতা-পাতিনেতা তৈরি হয় বহুসংখ্যক। দলের সিনিয়র নেতাকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে দু’একটা ব্যানার ফেস্টুন ছাপিয়ে বনে যান দলনেতা। তবে ওইখানকার মূল নেতারা সর্তকতা অবলম্বন করলেই এরা দাড়াতে পারবে না। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এইসব গ্যাং লিডারদের সম্পর্কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলেই এরা নির্মূল হবে, জনগণ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমানকে এইসব গ্যায়ের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, জনতার উপর নির্যাতন করে বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেনি। দলের নেতা পরিচয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, সজু আমাদের দলের কোনো পদপদবীতে নাই। তবে শফি জেলায় সেচ্ছাসেবক লীগ করেছে এটা জানি।
সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়া জানান, যাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে প্রতিকার তারাই করবে। আমাদের কাছে কেউ কিছু বলেনি। যাদের ক্ষতি করা হচ্ছে তারা পদক্ষেপ নেক। আমরা ওদের (অভিযুক্ত) পক্ষ অবলম্বন করলেই তো আমাদের দলের বদনাম হবে।
দলের লোক পরিচয় দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, দলের কোনো নেতা যদি ওদের পক্ষ অবলম্বন করে তাহলেই তো দলের সমস্যা হবে। যে দলই করুক অন্যায় করার অধিকার কারোই নেই। এ দেশে যারা জন্মগ্রহণ করেছে নাগরিকত্ব সবার আছে। কিছু কিছু বিষয় আছে সাধারণ মানুষের ওপর আমাদের দ্বারা করা সম্ভব হয়। আবার দেখা যায় অনেক কিছুই আমরা করতে পারি না। সেগুলো যাদের মাধ্যমে বিচার পাওয়া যাবে সেখানে গেলেই হয়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা জানান, দুটি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শান্তিপ্রিয় এলাকাকে অশান্ত করতে দেয়া হবে না। অতি দ্রুত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নারায়ণগঞ্জ ডিবির ইনচার্জ (ওসি) আল মামুন জানান, আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ এলে আমরা আইনগত, আইনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবো। পাশাপাশি আমাদের নজরে এসেছে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটে থাকে সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করবো।
র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। তবে ওই এলাকার কেউ এখনো আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেনি। আমরা যদি অভিযোগ পাই তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৫০:১৮ ৪৯ বার পঠিত